আক্বীদাহ কী?
মানুষ যা সত্য বলে (অন্তরে) বিশ্বাস করে এবং যাকে সে দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করে তাই তার আকীদাহ। এই আকীদাহ যদি আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত রাসূলগণের দ্বীন এবং তার নাযিলকৃত কিতাবসমূহ অনুযায়ী হয়, তাহলে তা সহীহ আকীদাহ হিসাবে গণ্য হয়। তার মাধ্যমে আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সৌভাগ্য লাভ করা যাবে।আর এ আকীদা যদি আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত রসূলগণের আনীত আকীদার বিরোধী হয় এবং তার নাযিলকৃত আসমানী কিতাবসমূহের পরিপন্থী হয়, তাহলে তার অনুসারীরা আযাবের সম্মুখীন হবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে হতভাগ্য হবে।
কেউ পরিশুদ্ধ আকীদাহ গ্রহণ করলে দুনিয়াতে তার জান-মাল নিরাপদ থাকবে এবং অন্যায়ভাবে তার উপর আক্রমণ করা নিষিদ্ধ হবে।
আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে সঠিক আক্বীদাহ
আল্লাহ তায়ালার রুবুবিয়্যাহ
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ﴾
‘‘তুমি যদি এদের জিজ্ঞাসা করো, কে এদেরকে সৃষ্টি করেছে? তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, আল্লাহ। তাহলে কোথা থেকে এরা প্রতারিত হচ্ছে? (সূরা যুখরুফ: ৮৭)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ الْعَزِيزُ الْعَلِيمُ﴾
‘‘তুমি যদি এসব লোকদের জিজ্ঞাসা করো, আসমান-যমীন কে সৃষ্টি করেছে? তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী সত্তা এগুলো সৃষ্টি করেছেন’’। (সূরা যুখরুফ: ৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿قُلْ مَن رَّبُّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ سَيَقُولُونَ الله﴾
‘‘তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো, সাত আসমান ও মহান আরশের অধিপতি কে? তারা নিশ্চয় বলবে, আল্লাহ’’। (সূরা মুমিনুন: ৮৬-৮৭)
এ রকম আয়াত কুরআনে অনেক রয়েছে। কাফেরদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার রুবুবীয়াত স্বীকার করতো। তারা বিশ্বাস করতো আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা, রিযিক দাতা, জীবন দাতা এবং মৃত্যু দাতা। মানব জাতির সামান্য লোকই কেবল তাওহীদুর রুবুবীয়াত এবং প্রভুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে।
কেউ কেউ প্রকাশ্যে প্রভু ও স্রষ্টাকে অস্বীকার করলেও গোপনে এবং হৃদয়ের গভীর থেকে স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে। অহংকার করার কারণেই কেবল তারা প্রকাশ্যে প্রভুকে অস্বীকার করেছে। আল্লাহ তা‘আলা ফেরাআউন সম্পর্কে বলেন যে, সে বলেছিল,
﴿يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرِي ﴾
‘‘হে সভাসদবর্গ! আমি তো নিজেকে ছাড়া তোমাদের আর কোনে প্রভু আছে বলে জানি না’’। (সূরা কাসাস: ৩৮)
আল্লাহর নবী মূসা আলাইহিস সালামের কথা থেকে বুঝা যায় ফেরাউন আল্লাহর উপর ঈমান রাখতো। আল্লাহ তা‘আলা মূসার উক্তি উল্লেখ করে বলেন,
﴿قَالَ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أَنزَلَ هَٰؤُلَاءِ إِلَّا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ بَصَائِرَ﴾
‘‘তুমি খুব ভাল করেই জান এ প্রজ্ঞাময় নিদর্শনগুলো আকাশ ও পৃথিবীর রব ছাড়া আর কেউ নাযিল করেননি’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ১০২)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
﴿وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا﴾
‘‘তারা একেবারেই অন্যায়ভাবে অহংকারের সাথে নিদর্শনগুলো অস্বীকার করলো অথচ তাদের মনমগজ সেগুলোর সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছে’’। (সূরা নামাল: ১৪)
তারা সত্য অস্বীকারের ক্ষেত্রে কোনো দলীল-প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেনি। কেবল অহংকার করেই তারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَقَالُوا مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ وَمَا لَهُم بِذَٰلِكَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ﴾
‘‘এরা বলে, জীবন বলতে তো শুধু আমাদের দুনিয়ার এ জীবনই। আমাদের জীবন ও মৃত্যু এখানেই এবং কালের বিবর্তন ছাড়া আর কিছুই আমাদেরকে ধ্বংস করে না। প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে এদের কোনো জ্ঞান নেই। এরা শুধু ধারণার উপর নির্ভর করে এসব কথা বলে’’। (সূরা জাছিয়া: ২৪)
সুতরাং তাদের কাছে এমন কেনো জ্ঞান ছিল না, যা তাদেরকে স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করার পথ দেখিয়েছে: বরং আসমানী শরী‘আত, মানুষের বিবেক-বুদ্ধি এবং সৃষ্টিগত স্বভাব সবই স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার ও সাব্যস্ত করেছে।
এ সৃষ্টিজগত এবং তাতে যা কিছু সংঘটিত হচ্ছে তা সবই আল্লাহ তা‘আলার একত্ব এবং তার প্রভুত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ। কেননা সৃষ্টির জন্য স্রষ্টা থাকা আবশ্যক। সৃষ্টিজগতে যা কিছু প্রবর্তিত হচ্ছে, তার জন্য প্রবর্তক থাকা আবশ্যক।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمْ الْخَالِقُونَ * أَمْ خَلَقُوا السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بَل لاَ يُوقِنُونَ﴾
‘‘তারা কি কোনো কিছু ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে? না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? না কি তারা আকাশম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে? বরং তারা বিশ্বাস করে না’’। (সূরা তুর: ৩৫-৩৬)
কবি বলেছেন, وَفِي كُلِّ شَيْءٍ لَهُ آيَةٌ... تَدُلُّ عَلَى أَنَّهُ وَاحِد প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে তার নিদর্শন রয়েছে, যা প্রমাণ করে তিনি একক। তারা কি কোনো কিছু ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে? না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? এ প্রশ্নটির জবাব দেয়া আবশ্যক। তাই স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নাস্তিকরা এলোমেলো জবাব দিয়েছে। তারা কখনো বলেছে, প্রকৃতির নিয়মেই এ সৃষ্টিজগত সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে উদ্ভিদ, জীব ও জড় বস্ত্তকে প্রকৃতি বলা হয়। এ বিশাল সৃষ্টিজগতের সবকিছু তাদের নিকট প্রকৃতি। এ নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে!!
তারা কখনো বলেছে, উদ্ভিদ, জীব ও জড় বস্ত্তর বিভিন্ন স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের নামই প্রকৃতি। যেমন গরম হওয়া, ঠান্ডা হওয়া, আদ্র হওয়া, শুস্ক হওয়া, মসৃণ হওয়া, মোটা হওয়া, নড়াচড়া করা, স্থির হওয়া, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া, প্রজনন, বংশ বিস্তার করা ইত্যাদি সব কিছু প্রাকৃতিক নিয়মে হয়। তাদের মতে বস্ত্তসমূহের স্বভাব এবং বিভিন্ন অবস্থায় সেটা রূপান্তরিত হওয়ার যে যোগ্যতা ও ক্ষমতা রাখে তাকেই প্রকৃতি বলা হয়। তাদের মতে এ স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যগুলোই সৃষ্টিজগতের সবকিছু সৃষ্টি করেছে।
উভয় দিক থেকেই তাদের কথা বাতিল। যদি বলা হয় উদ্ভিদ, জীব ও জড় পদার্থগুলোর নামই প্রকৃতি এবং প্রকৃতি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে, তাহলে তাদের কথা অনুযায়ী প্রকৃতি একই সাথে স্রষ্টা ও সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক হয়। এতে আবশ্যক হয় যে, পৃথিবী নিজেই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছে, আকাশও নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে কথা একই...। এটি অসম্ভব।
এভাবে প্রকৃতির নিয়মে এক বস্ত্তর সত্তা থেকে সমজাতীয় আরেক বস্ত্তর সত্তা সৃষ্টি হওয়া যদি অসম্ভব হয়, তাহলে দ্বিতীয় পদ্ধতিতে সৃষ্টি হওয়া আরো বেশী কঠিন। অর্থাৎ কেননা কোনো বস্ত্ত নিজেই যদি নিজেকে সৃষ্টি করতে না পারে, তাহলে বস্ত্তর স্বভাব-বৈশিষ্ট্য বস্ত্তকে সৃষ্টি করা আরো বেশী অসম্ভব। কেননা موصوف বা বিশেষিত সত্তার সাথে যুক্ত না হয়ে صفة বা স্বভাব ও বিশেষণ অস্তিত্বশীল হয় না। সুতরাং ছিফাত কিভাবে মাউসুফকে সৃষ্টি করতে পারে!! অথচ ছিফাত নিজেই মাউসুফের প্রতি মুখাপেক্ষী। সুতরাং যখন দলীল-প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত হলো যে মাউসুফ সৃষ্টি হয়েছে, তখন এ বিশ্বাস করা আবশ্যক যে ছিফাতও সৃষ্টি হয়েছে। আরেকটি কথা বুঝা দরকার যে, প্রকৃতির কোনো অনুভুতি নেই। এটি একটি যন্ত্রের মত। সুতরাং তা থেকে কিভাবে এত বিশাল বিশাল ও সুনিপুন-অভিনব কাজ-কর্ম তৈরী হতে পারে, যা সর্বোচ্চ প্রজ্ঞার সাথে সম্পন্ন করা হয়েছে এবং যা পরস্পর মিলে একটি সুশৃঙ্খল বন্ধনে আবদ্ধ রয়েছে।
নাস্তিকদের কেউ কেউ বলে থাকে, এ সৃষ্টিজগত আকস্মিকভাবে তৈরী হয়। অর্থাৎ আকস্মিকভাবে অনেকগুলো অণু-পরমাণু ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্ত্ত একসাথে মিলিত হয়ে প্রাণ তৈরী হয়। এতে কোনো স্রষ্টা ও ব্যবস্থাপকের ব্যবস্থাপনা ও কলা-কৌশলের প্রয়োজন হয় না। এটি একটি বাতিল কথা। বিবেক-বুদ্ধি ও সৃষ্টিগত স্বভাব এ ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে। কেননা আপনি যখন এ সুশৃঙ্খল সৃষ্টিজগতের মহাশূন্য, ভূপৃষ্ঠ এবং মহাকাশে সুক্ষ্ম, বিস্ময়কর ও সুবিন্যস্তভাবে চলাচলকারী সৃষ্টিসমূহের প্রতি গভীর দৃষ্টি দিবেন, তখন আপনার কাছে সুস্পষ্ট হয় যাবে যে, প্রজ্ঞাবান এক স্রষ্টা ব্যতীত এসব তৈরী হওয়া মোটেই সম্ভব নয়।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, তুমি স্রষ্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী নাস্তিককে জিজ্ঞাসা করো, ঐ মেশিনের ব্যাপারে তোমার ধারণা কী, যা একটি নদীতে রাখা হয়েছে। তার যন্ত্রাংশগুলো মজবুত, সেগুলো মজবুতভাবে লাগানো হয়েছে এবং অত্যন্ত সুন্দরভাবে সেগুলো তৈরী করা হয়েছে। দর্শক মেশিনের ভিতরে যেমন কোনো দোষ ধরতে পারে না তেমনি তার বাহ্যিক সৌন্দর্যের মধ্যেও কোনো ত্রুটি খুঁজে পায় না। আর এ মেশিনটি দিয়ে বিরাট একটি বাগানে পানি দেয়া হচ্ছে। বাগানে রয়েছে প্রত্যেক প্রকার ফলফলাদির গাছপালা। মেশিনটি বাগানের গাছপালা ও ফল-ফসলের চাহিদা মোতাবেক পানি সরবরাহ করছে। ঐদিকে বাগানকে ঠিক-ঠাক রাখার জন্য তাতে একজন পরিচর্যাকারী রয়েছে। সে ভালোভাবে বাগানের যত্ন নেয়, খোঁজ-খবর রাখে এবং বাগানের সার্বিক কাজ-কর্ম সম্পন্ন করে। বাগানের কোনো কিছুই ত্রুটিযুক্ত রাখে না। অতঃপর লোকটি বাগানের ফল-ফসল উঠিয়ে মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুসারে তাদের মধ্যে ভাগ-বন্টন করে দেয়। প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষকেই প্রয়োজন মোতাবেক দান করে। সর্বদা সে এ রকমই করতে থাকে। তুমি কি মনে করো কোনো কারিগর ও ব্যবস্থাপক ছাড়াই বাগান এবং তার সবকিছু আকস্মিকভাবে হয়ে গেছে?
বাগানে পানি দেয়ার মেশিনটি এমনিতেই হয়ে গেছে? বাগান ও তার ভিতরকার পরিবেশ হঠাৎ করেই তৈরী হয়েছে?
কোনো কর্তা, পরিচালক ও ব্যবস্থাপক ছাড়াই এসব কিছু আকস্মিকভাবেই হয়ে গেছে?
তোমার যদি বিবেক-বুদ্ধি থাকে, তাহলে এসবের ব্যাপারে তোমার বিবেক কী বলে তা খেয়াল করো। তোমার বিবেক কী জবাব দেয় তা ভালোভাবে বুঝো এবং কী দিক নির্দেশনা দেয় তা অনুধাবন করো। কিন্তু মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলার হিকমতের দাবি এ যে, তিনি এমন কিছু অন্তর সৃষ্টি করেছেন, যা সম্পূর্ণ অন্ধ, তাতে কোনো আলো নেই। যার কারণে সে উজ্জ্বল ঝকঝকে নিদর্শনগুলো কেবল ঐসব চতুষ্পদ জন্তুর মতোই দেখতে পায় যাদের চক্ষু আছে ঠিকই; কিন্তু তাতে কোনো আলো নেই। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের উক্তি এখানেই শেষ।
আল্লাহ তায়ালার উলূহিয়্যাহ
সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য খাসভাবে সম্পন্ন করাকে توحيد الألوهية বলা হয়। উলুহীয়াত অর্থ ইবাদত। الإله অর্থ মাবুদ। এ জন্যই এ প্রকার তাওহীদকে توحيد العبادة বলেও নামকরণ করা হয়।
العبادة শব্দের আভিধানিক অর্থ নত হওয়া, বশীভুত হওয়া, পদদলিত হওয়া ইত্যাদি। যখন কোনো রাস্তার উপর দিয়ে পদচারণ করা হয়, তখন তাকে طريق معبد বলা হয়। অর্থাৎ পদদলিত ও বশীভুত রাস্তা। আলেমগণ ইবাদতের পারিভাষিক অর্থ আলোচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন বাক্য ব্যবহার করেছেন। তবে তার মূল অর্থে সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
একদল আলেমের মতে প্রচলিত সামাজিক প্রথা ও বিবেক-বুদ্ধির দাবি ছাড়াই যা বাস্তবায়ন করার জন্য শরী‘আতের পক্ষ হতে আদেশ করা হয়েছে, তাই ইবাদত। আরেক দল আলেমের মতে পরিপূর্ণ বিনয় মিশ্রিত পরিপূর্ণ ভালোবাসাকে ইবাদত বলা হয়।
শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ ইবাদতের পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
العبادة اسم جامع لكل ما يحبه الله ويرضاه من الأقوال والأعمال الظاهرة والباطنة
আল্লাহ তা‘আলা বান্দার যেসব প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কাজকে ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন, তার নামই ইবাদত।
ইবাদতের এ সংজ্ঞাটিই সর্বাধিক সূক্ষ্ম ও অধিকতর ব্যাপক। কেননা দীনের সবকিছুই ইবাদতের মধ্যে গণ্য। যারা বিনয় মিশ্রিত ভয়কে ইবাদত বলে নামকরণ করেছেন, তাদের কথা হলো পরিপূর্ণ বিনয়ের সাথে পরিপূর্ণ ভালোবাসা প্রিয়পাত্রের আনুগত্য করা ও তার সামনে নত হওয়ার দাবি জানায়। বান্দাকে কেবল ভালোবাসা ও বিনয়ই প্রিয়পাত্রের জন্য নত করে। সুতরাং বান্দার পক্ষ হতে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ভালোবাসা ও তার সামনে নত হওয়া অনুপাতেই বান্দার আনুগত্য হয়ে থাকে। বান্দার তরফ থেকে তার রবের প্রতি ভালোবাসা এবং তার রবের সামনে বিনয়ী ও নত হওয়া একমাত্র তারই ইবাদতের দাবি জানায়। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তার কোনো শরীক নেই।
ইসলামী শরী‘আতে যেসব ইবাদতের আদেশ এসেছে, তাতে একই সঙ্গে বিনয়-নম্রতা ও ভালোবাসা থাকা আবশ্যক। এতে তিনটি রুকন থাকা জরুরী। ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্খা এবং ভয়-ভীতি। ইবাদতের মধ্যে এসব বিষয় একসাথে বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। যে ব্যক্তির মধ্যে এগুলো থেকে শুধু একটি পাওয়া যাবে, সে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতকারী নয়। অন্তরে শুধু ভালোবাসা নিয়ে ইবাদত করা সুফীদের তরীকা, শুধু আশা-আকাঙ্খা নিয়ে ইবাদত করা মুরজিয়াদের তরীকা, আর শুধু ভয় নিয়ে ইবাদত করা খারেজীদের তরীকা।
বিনয়হীন ভালোবাসা ইবাদতের মধ্যে গণ্য নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি কোনো জিনিসকে ভালোবাসে ঠিকই; কিন্তু তার সামনে নত হয় না, সে তার ইবাদতকারী হিসাবে গণ্য নয়। যেমন কোনো মানুষ তার সন্তান ও বন্ধুবান্ধবকে ভালোবাসে। এ ভালোবাসা ইবাদত নয়। এমনি ভালোবাসাবিহীন নতি স্বীকারও ইবাদত নয়। যেমন রাজা-বাদশা কিংবা যালেম ও সন্ত্রাসীর ক্ষতি থেকে বাচার জন্য মানুষ তাদের সামনে নত হয়। এ নতি স্বীকারও ইবাদত নয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের ক্ষেত্রে এ দু’টি বিষয়ের একটি অন্যটি থেকে আলাদা হলে ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে না। বরং বান্দার নিকট আল্লাহ তা‘আলা সর্বাধিক প্রিয় হওয়া আবশ্যক। সে সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার সামনে বান্দা সর্বাধিক বিনয়ী হওয়া ও নতি স্বীকার করা আবশ্যক।
সুতরাং বান্দার ইবাদত আল্লাহ তা‘আলার কাছে খুব প্রিয় এবং এটা তার সন্তুষ্টি পাওয়ার মাধ্যম। ইবাদতের জন্যই আল্লাহ তা‘আলা মাখলুক সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ ( ৫৭) إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ﴾
‘‘আমি জিন এবং মানবকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে কোনো রিযিক চাই না কিংবা তারা আমাকে খাওয়াবে তাও চাই না। আল্লাহ নিজেই রিযিকদাতা এবং প্রবল শক্তিধর ও পরাক্রমশালী’’। (সূরা যারিয়াত: ৫৬-৫৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন.
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾
‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল পাঠিয়েছি। তার মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’। (সূরা আন নাহল: ৩৬)
আল্লাহ তায়ালার আসমা এবং সিফাতসমূহ
আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তার জন্য অথবা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রবের জন্য পূর্ণতার যেসব গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন, তা সাব্যস্ত করা এবং আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তা থেকে অথবা তার রসূল তার থেকে অপূর্ণতার যেসব দোষ-ত্রুটি নাকোচ করেছেন, তা নাকোচ করাকে তাওহীদুল আসমা ওয়াছ ছিফাত বলা হয়। পূর্ণতার ছিফাতগুলো সাব্যস্ত এবং অপূর্ণতার ছিফাতগুলো নাকোচ করার ক্ষেত্রে তাদের মূলনীতি হলো, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ﴾
‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’।[1] (সূরা শুরা: ১১)
জাহমীয়া সম্প্রদায় এবং তাদের অনুসরণকারী মু‘তাযিলা ও আশায়েরাগণ এ প্রকার তাওহীদ অস্বীকার করেছে। তাওহীদুল আসমা ওয়াছ ছিফাত তাওহীদুর রুবুবীয়াতেরই অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এর অস্বীকার কারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং এ সম্পর্কে প্রচুর সন্দেহ ছড়ানোর কারণে স্বতন্ত্র একটি প্রকার সিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে অনেক কিতাবও লেখা হয়েছে।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ তার প্রসিদ্ধ একটি কিতাবে জাহমীয়াদের প্রতিবাদ করেছেন। তার ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনে আহমাদ আস্ সুন্নাহ’ নামে একটি কিতাব রচনা করেছেন, আব্দুল আযীয আলকিনানী লিখেছেন, الحيدة في الرد على بشر المريسي নামে একটি কিতাব, আবু আব্দুল্লাহ আলমিরওয়াযী লিখেছেন, السنة নামে একটি কিতাব, উছমান ইবনে সাঈদ আদ্দারামী লিখেছেন, الرد على بشر المريسي নামে একটি কিতাব এবং এ ব্যাপারে সকল ইমামের সরদার মুহাম্মাদ ইবনে খুযায়মা লিখেছেন التوحيد নামে একটি কিতাব। উপরোক্ত ইমামগণ ছাড়াও শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং তার সুযোগ্য ছাত্র ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ জাহমীয়াদের প্রতিবাদে কিতাব রচনা করেছেন। এসব ইমাম এবং তাদের পরবর্তীতে আগমনকারী ইমামগণ পূর্ববর্তী ইমামগণের পথ অবলম্বন করেছেন। সত্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হওয়া এবং বাতিল পরাভূত হওয়ার জন্য আল্লাহর প্রশংসা করছি।
কতিপয় আরব মুশরিকদের থেকে সর্বপ্রথম আল্লাহর ছিফাত অস্বীকার করার বিষয়টি জানা যায়। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতটি নাযিল করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿كَذَلِكَ أَرْسَلْنَاكَ فِي أُمَّةٍ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهَا أُمَمٌ لِتَتْلُوَ عَلَيْهِمُ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَهُمْ يَكْفُرُونَ بِالرَّحْمَنِ قُلْ هُوَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ مَتَابِ﴾
‘‘এভাবে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি এমন এক জাতির প্রতি, যার পূর্বে বহু জাতি গত হয়েছে। যাতে আমি তোমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করেছি, তাদের নিকট তা পাঠ করতে পারো। তারা রাহমানকে তথা পরম দয়াময়কে অস্বীকার করে। বলোঃ তিনিই আমার প্রতিপালক। তিনি ব্যতীত অন্য কোনো সত্য উপাস্য নেই। আমি তার উপরই ভরসা করেছি এবং তার দিকেই আমার প্রত্যাবর্তন’’। (সূরা আর রা’দ: ৩০)
এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার কারণ হলো কুরাইশরা যখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তা‘আলার الرحمن নাম উচ্চারণ করতে শুনলো, তখন তারা সেটাকে অস্বীকার করলো। তাদের জবাবে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেছেন,
﴿وَهُمْ يَكْفُرُونَ بِالرَّحْمَنِ﴾
‘‘এবং তারা রহমানকে অস্বীকার করে’’ (সূরা আর রা‘দ ১৩:৩০)।
ইমাম ইবনে জারীর উল্লেখ করেছেন যে, এটি ছিল হুদায়বিয়ার ঘটনা। হুদায়বিয়ার সন্ধির লেখক যখন بسم الله الرحمن الرحيم লিখলেন, তখন কুরাইশরা বললো, আমরা রাহমানকে চিনি না’’।
ইমাম ইবনে জারীর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিজদায় يا رحمن এবং يا رحيم বলে দু‘আ করতেন। মুশরিকরা এতে বলতে লাগলো, মুহাম্মাদ বলে যে, সে মাত্র এক মাবুদকে ডাকে। অথচ দেখছি সে দুই মাবুদকেই ডাকে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ ادْعُوا اللَّهَ أَوْ ادْعُوا الرَّحْمنَ أَيًّا مَا تَدْعُوا فَلَهُ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى﴾
‘‘বলো, তোমরা আল্লাহ্কে ‘আল্লাহ’ নামে আহবান করো কিংবা ‘রাহমান’ নামে আহবান করো, তোমরা যে নামেই আহবান করো না কেন, তার রয়েছে অনেক অতি সুন্দর নাম’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ১১০) আল্লাহ তা‘আলা সূরা ফুরকানে বলেন,
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اسْجُدُوا لِلرَّحْمَنِ قَالُوا وَمَا الرَّحْمَنُ﴾
‘‘তোমরা যখন রাহমান বা পরম দয়াময়ের নামে সিজদাবনত হও, তখন ওরা বলে, রাহমান আবার কে?। (সূরা আল ফুরকান: ৬০)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুমহান গুণাবলী অস্বীকার করার ক্ষেত্রে মুশরেকরাই জাহমীয়া এবং আশায়েরাদের উস্তাদ। নিকৃষ্ট ছাত্রদের নিকৃষ্ট উস্তাদ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ بِئْسَ لِلظَّالِمِينَ بَدَلًا﴾
‘‘তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে ও তার বংশধরকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করবে? অথচ তারা তোমাদের শত্রু? বড়ই খারাপ বিনিময় যালেমরা গ্রহণ করছে! (সূরা কাহাফ: ৫০)
আর নবী-রসূলগণ এবং তাদের অনুসারীগণ বিশেষ করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সম্মানিত সাহাবীগণ ও উত্তমভাবে তাদের অনুসারীগণ আল্লাহ তা‘আলাকে ঐসব গুণে গুণান্বিত করেছেন, যা দিয়ে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে গুণান্বিত করেছেন এবং তার থেকে ঐসব দোষ-ত্রুটি নাকোচ করেছেন, যা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা নিজের সত্তা থেকে নাকোচ করেছেন। সেই সঙ্গে যারা এ মানহাজের বিরোধিতা করে তারা তাদেরও প্রতিবাদ করেছেন।
আব্দুর রাজ্জাক মা’মার থেকে, মা’মার তাউস থেকে, তাউস তার পিতা থেকে, তার পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি দেখলেন একজন লোক আল্লাহর ছিফাত সংক্রান্ত একটি হাদীছ শুনে কেঁপে উঠছে। সে এটিকে অপছন্দ করেই কেঁপে উঠছিল। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তখন বললেন, এরা আল্লাহ তা‘আলাকে কেমন ভয় করে? কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত শুনে নরম হয়। আর যখন কোনো অস্পষ্ট আয়াত শুনে তখন ধ্বংস হয় এবং তা অস্বীকার করে?’’
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মজলিসে যেসব সাধারণ লোক উপস্থিত হতো, এখানে তিনি তাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তারা যখন আল্লাহর ছিফাত সংক্রান্ত কোনো মুহকাম আয়াত শুনতো তখন তারা ভয় করতো এবং তারা আল্লাহর ছিফাতসমূহকে অস্বীকারকারীদের মতো কেঁপে উঠতো। তারা ঐসব লোকদের মতো যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ﴾
‘‘যাদের মনে বক্রতা আছে তারা ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সবসময় মুতাশাবিহার পিছনে লেগে থাকে এবং তার অর্থ করার চেষ্টা করে। অথচ সেগুলোর আসল অর্থ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানে না। অপর পক্ষে পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারীরা বলেঃ আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এসব আমাদের রবের পক্ষ থেকেই এসেছে। আর প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানবান লোকেরাই শিক্ষা গ্রহণ করে’’। (সূরা আলে-ইমরান: ৭)
সুতরাং বাঁকা অন্তর বিশিষ্ট লোকেরা মুহকাম আয়াতগুলো বাদ দিয়ে মুতাশাবিহাতের পিছনে লেগে থাকে এবং তারা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস করে এবং অপর অংশ অস্বীকার করে।
আর আল্লাহর ছিফাত সংক্রান্ত আয়াতগুলো মুহকামাতের অন্তর্ভুক্ত, মুতাশাবিহাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। উম্মতের প্রথম সারির আনসার ও মুহাজির মুসলিমগণ, উত্তমভাবে তাদের অনুসরণকারী তাবেঈগণ এবং তাদের পরবর্তীকালের মুজতাহিদ ইমামগণ তা পড়েছেন এবং তার অর্থ বুঝেছেন। তারা এগুলোর প্রতিবাদ করেননি। বর্তমানেও উম্মতের বিজ্ঞ আলেমগণ তা পড়ছেন, অনুধাবন করছেন এবং তা অন্যদেরকে পড়াচ্ছেন। এগুলো বুঝতে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
সুপ্রসিদ্ধ ইমাম অকী বলেন, আমরা আ’মাশ এবং সুফিয়ান রাহিমাহুল্লাহকে পেয়েছি যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সংক্রান্ত হাদীছগুলো বর্ণনা করতেন। তারা এগুলো বর্ণনা করাকে অপছন্দ করতেন না কিংবা এগুলোর প্রতিবাদ করতেন না।
বিদআতী মু‘তাযিলা, জাহমীয়া এবং আশায়েরা সম্প্রদায়ের লোকেরাই কেবল ছিফাত সংক্রান্ত হাদীছগুলো অস্বীকার করে। এ ক্ষেত্রে তারা কুরাইশদের ঐসব মুশরিকদের পথ অনুসরণ করেছে, যারা আল্লাহ তা‘আলার রাহমান নামকে অস্বীকার করেছিল এবং আল্লাহ তা‘আলার নামের বিকৃতি ঘটিয়েছিল।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা আরাফের ১৮০ নং আয়াতে বলেন,
﴿وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
‘‘আল্লাহ তা‘আলার অনেকগুলো অতি সুন্দর নাম রয়েছে। সুতরাং তাকে সে নামেই ডাকো এবং তার নামসমূহের মধ্যে যারা বিকৃতি করে, তোমরা তাদেরকে বর্জন করো। তারা যা করে আসছে, তার ফল তারা অবশ্যই পাবে’’।[2]
আল্লাহ তা‘আলা এখানে নিজের জন্য অতি সুন্দর নাম সাব্যস্ত করেছেন এবং সেটার মাধ্যমে তাকে ডাকার আদেশ দিয়েছেন। এদের ধারণা মোতাবেক আল্লাহ তা‘আলার যদি নামই না থাকে এবং নামগুলোর অর্থ বোধগম্য না হয় তাহলে তাকে কিভাবে ডাকা হবে? আল্লাহ তা‘আলার নামের মধ্যে যারা বিকৃতি করে এবং তার নামগুলোকে নাকোচ করে অথবা সেটার সঠিক অর্থ বাদ দিয়ে এভাবে ব্যাখ্যা করে যে, শাস্তি ও আযাবের মাধ্যমে তিনি তাদের আমলের বদলা দিবেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী
﴿وَهُمْ يَكْفُرُونَ بِالرَّحْمَنِ﴾
‘‘এবং তারা রহমানকে অস্বীকার করে’’ (সূরা আর রা‘দ ১৩:৩০)।
এর মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা মক্কার কুরাইশদেরকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ তারা আল্লাহ তা‘আলার রাহমান নামকে অস্বীকার করেছিল। এ জন্যই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনেক আলেম জাহমীয়াদেরকে কাফের বলেছেন।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
ولقد تقلد كفرهم خمسون في ... عشر من العلماء في البلدان
واللالكائي الإمام حكاه عنهم ... بل قد حكاه قبله الطبراني
বিভিন্ন দেশের পাঁচশত আলেম জাহমীয়াদেরকে কাফের বলেছেন এবং তাদের কাফের হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। ইমাম লালাকায়ী আলেমদের থেকে তাদের কাফের হওয়ার ফতোয়া উল্লেখ করেছেন এবং তার পূর্বে ইমাম তাবারানীও উল্লেখ করেছেন।[3]
[1]. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শুরা: ১১) এখানে নাকোচ করা হয়েছে এবং সাব্যস্ত করা হয়েছে। সৃষ্টির মধ্য থেকে কোনো কিছু আল্লাহর সদৃশ হওয়ার ধারণা নাকোচ করা হয়েছে এবং তাঁর জন্য শ্রবণ ও দৃষ্টি সাব্যস্ত করা হয়েছে। আলেমগণ বলেন, আরবদের সুপ্রসিদ্ধ একটি প্রবাদ বাক্য ও মূলনীতি অনুসারে এখানে নফীকে ইছবাতের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রথমে আল্লাহ তা‘আলা থেকে অপূর্ণতার বিশেষণ ও দোষত্রুটি নাকোচ করা হয়েছে অতঃপর তাঁর জন্য পূর্ণতার গুণাবলী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আরবরা বলে থাকে, التخلية تسبق التحلية ‘‘সাজসজ্জার পূর্বে পরিস্কার করা আবশ্যক’’। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলাকে পূর্ণতার বিশেষণের মাধ্যমে বিশেষিত করার আগে অন্তর থেকে স্রষ্টাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা কিংবা সৃষ্টির সাথে স্রষ্টাকে তুলনা করার দোষ-ত্রুটি থেকে খালি করা আবশ্যক। অন্তর যখন তাশবীহ ও তামছীলের দোষ থেকে খালি হবে, তখনই আল্লাহ তা‘আলার জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতে পূর্ণতার গুণাবলী সাব্যস্ত করা হবে। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার জন্য দু’টি ছিফাত সাব্যস্ত করা হয়েছে। একটি শ্রবণ এবং অন্যটি দৃষ্টি।
আলেমগণ আরো বলেন, আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে উক্ত আয়াতে অন্যান্য ছিফাত বাদ দিয়ে শ্রবণ ও দৃষ্টিকে একসাথে উল্লেখ করার কারণ হলো, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রাণবিশিষ্ট অধিকাংশ সৃষ্টির মধ্যেই রয়েছে। যেসব সৃষ্টির মধ্যে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হওয়ার শক্তি থাকার সাথে সাথে প্রাণ বা রূহ আছে, তাদের সবগুলোর মধ্যেই শ্রবণ ও দৃষ্টি শক্তি রয়েছে। মানুষের রয়েছে শ্রবণ ও দৃষ্টি এবং সমস্ত প্রাণীর রয়েছে শ্রবণ ও দৃষ্টি। মাছির রয়েছে তার জন্য শোভনীয় শ্রবণ ও দৃষ্টি। উটের রয়েছে শোভনীয় শ্রবণ ও দৃষ্টি। এমনি সমস্ত পাখি, মাছ, ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী অন্যান্য জীব-জন্তু এবং কীটপতঙ্গের রয়েছে শোভনীয় শ্রবণ ও দৃষ্টি।
আর জ্ঞানীদের কাছে সুস্পষ্ট যে, সমস্ত প্রাণীর শ্রবণ ও দৃষ্টি একরকম নয়। মানুষের শ্রবণ-দৃষ্টি প্রানীর শ্রবণ-দৃষ্টির অনুরূপ নয়। মানুষের শ্রবণ-দৃষ্টি সমস্ত প্রাণীর শ্রবণ-দৃষ্টির চেয়ে পূর্ণতম। তবে মানুষ এবং অন্যান্য সকল প্রাণীর জন্য শ্রবণ ও দৃষ্টি বিশেষণের মূল অংশ যৌথভাবে সাব্যস্ত। তবে প্রত্যেক প্রাণীর জন্য যতটুকু শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রয়োজন তার মধ্যে শোভনীয় পদ্ধতিতে কেবল ততটুকুই স্থাপন করা হয়েছে। সুতরাং প্রাণী ও জীব-জন্তুর মধ্যে শ্রবণ ও দৃষ্টি আছে। মানুষের মধ্যেও শ্রবণ-দৃষ্টি আছে। মানুষের মধ্যে শ্রবণ ও দৃষ্টি আছে বলেই তা প্রাণী ও জীব-জন্তুর শ্রবণের মতো নয়।
সুতরাং মহান মালিক, চিরঞ্জীব সত্তা ও সবকিছুর ধারক আল্লাহ তা‘আলার জন্য শ্রবণ ও দৃষ্টি বিশেষণ সাব্যস্ত করলে তা সৃষ্টির গুণের সাদৃশ্য হয়ে যায় কিভাবে!! আসল কথা হলো মহান স্রষ্টার রয়েছে এমন শ্রবণ ও দৃষ্টি, যা তাঁর বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয়। যেমন রয়েছে নগণ্য মাখলুকের জন্য প্রয়োজনীয় ও শোভনীয় শ্রবণ ও দৃষ্টি। আল্লাহ তা‘আলার শ্রবণ ও দৃষ্টি বিশেষণ সকল দিক মূল্যায়নে পূর্ণতম এবং সকল দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত। কিন্তু কোনো মাখলুকের শ্রবণ ও দৃষ্টি সকল দিক মূল্যায়নে পূর্ণতম নয় এবং তা দোষ-ত্রুটি থেকে একেবারে মুক্তও নয়। আল্লাহ তা‘আলার বাকীসব সিফাতের ক্ষেত্রেও একই কথা। যদিও সকল সিফাতের মূল অংশ আল্লাহ তা‘আলা এবং বান্দার জন্য যৌথভাবে সাব্যস্ত। পার্থক্য হবে শুধু পরিমাণ ও পদ্ধতির ক্ষেত্রে। অর্থাৎ নগণ্য মাখলুকের ছিফাত নগণ্য এবং সেটার অনেক সিফাতের ধরণ আমাদের জানা আছে। আর মহান ও অসীম স্রষ্টার সিফাতের পরিমাণ তাঁর মতোই অসীম এবং তার পদ্ধতিও আমাদের জানা নেই।
সুতরাং মুমিন বান্দাদের উপর আবশ্যক হলো আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের সত্তার জন্য পূর্ণতার যেসব গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন কুরআন-সুন্নাহর মূলনীতি ও সালাফে সালেহীনদের মানহাজ অনুযায়ী তা তাঁর পবিত্র সত্তার জন্য সাব্যস্ত করা এবং তিনি তাঁর নিজের সত্তা থেকে যেসব অপূর্ণতা ও দোষ-ত্রুটি নাকোচ করেছেন, তা নাকোচ করা। সেই সঙ্গে আরো বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, স্রষ্টার জন্য পূর্ণতার বিশেষণ সাব্যস্ত করলে তা সৃষ্টির সিফাতের মত হয়ে যায় না।
[2]. إلحاد ( ইলহাদ) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বাঁকা হওয়া, একদিকে ঝুকে পড়া, কোন জিনিস থেকে সরে আসা, ইত্যাদি। এখান থেকেই কবরকে লাহাদ বলা হয়। কবরকে লাহাদ বলার কারণ হলো, সেটাকে খনন করার সময় গর্ত খননের সাধারণ রীতি ও পদ্ধতির ব্যতিক্রম করে কিবলার দিকে বাঁকা করে দেয়া হয়।
আর আল্লাহর অতি সুন্দর নাম, তাঁর সুউচ্চ গুণাবলী এবং আয়াতসমূহের মধ্যে ইলহাদ হচ্ছে সেটার প্রকৃত ও সঠিক অর্থ বাদ দিয়ে বাতিল অর্থের দিকে নিয়ে যাওয়া। আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর মধ্যে ইলহাদ কয়েক প্রকার।
(১) আল্লাহর নামে দেবতার নাম রাখা: আল্লাহর অন্যতম নাম الإله থেকে মুশরেকরা তাদের এক দেবতার নাম রেখেছে اللات ( লাত), আল্লাহর নাম العزيز থেকে তারা তাদের আরেক মূর্তির নাম রেখেছে العزى ( উয্যা) এবং আল্লাহর নাম المنان থেকে তারা তাদের আরেক বাতিল মাবুদের নাম রেখেছে مناة ( মানাত)।
(২) আল্লাহর এমন নাম রাখা, যা তার মর্যাদা ও বড়ত্বের শানে শোভনীয় নয়: যেমন খ্রিষ্টানরা আল্লাহকে أب ( FATHER বা পিতা) বলে। দার্শনিকরা আল্লাহকে موجب ( আসল সংঘটক) কিংবা علة فاعلة ( সক্রিয় কারণ) বলে থাকে।
(৩) আল্লাহকে এমন ত্রুটিযুক্ত বিশেষণে বিশেষিত করা, যা থেকে তিনি নিজেকে পবিত্র রেখেছেন: যেমন অভিশপ্ত ইয়াহূদীরা বলে থাকে ﴿إِنَّ اللَّهَ فَقِيرٌ وَنَحْنُ أَغْنِيَاءُ﴾ ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ গরীব আর আমরা ধনী’’। তারা আরো বলে,
﴿يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا ۘ بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ﴾
‘‘আল্লাহর হাত বাঁধা। আসলে বাঁধা হয়েছে ওদেরই হাত এবং তারা যে কথা বলছে সে জন্য তাদের উপর অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে। আল্লাহর দুই হাত সদা প্রসারিত। যেভাবে চান তিনি খরচ করেন’’। (সূরা মায়িদা: ৬৪)
তারা আরো বলে থাকে আল্লাহ তা‘আলা ছয়দিনে আসমান-যমীন এবং সেটার মধ্যকার সকল বস্তু সৃষ্টি করার পর শনিবারে বিশ্রাম নিয়েছেন। মূলতঃ আল্লাহ তাদের কথার অনেক উর্ধ্বে।
(৪) আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ ছিফাতগুলোর অর্থ ও হাকীকত অস্বীকার করা: যেমন জাহমীয়ারা বলে আল্লাহর নামগুলো শুধু শব্দের মধ্যেই সীমিত। এগুলো কোনো গুণ বা অর্থকে নিজের মধ্যে শামিল করে না। তারা বলে আল্লাহর অন্যতম নাম হচ্ছে, السميع ( সর্বশ্রোতা), কিন্তু এই নামটি প্রমাণ করে না যে, তিনি শুনেন কিংবা এটি প্রমাণ করে না যে, শ্রবণ করা তাঁর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট। আল্লাহর অন্যতম নাম হচ্ছে البصير ( সর্বদ্রষ্টা), কিন্তু এই নামটি প্রমাণ করে না যে, তিনি দেখেন কিংবা দেখা তাঁর গুণ এবং আল্লাহ তা‘আলার আরেকটি নাম হচ্ছে الحي ( চিরজীবন্ত), কিন্তু ইহা প্রমাণ করে না যে, তাঁর হায়াত বা জীবন আছে। আল্লাহর অন্যান্য নাম ও সিফাতের ক্ষেত্রেও তারা একই রকম কথা বলে থাকে।[2]
(৫) আল্লাহর ছিফাতসমূহকে মাখলুকের সিফাতের সাথে তুলনা করা: যেমন মুশাবেবহা (আল্লাহর ছিফাতকে সৃষ্টির সিফাতের সাথে তুলনাকারী) সম্প্রদায়ের লোকেরা করে থাকে। তারা বলে থাকে, আল্লাহর হাত আমার দুই হাতের মতোই। অন্যান্য সিফাতের বেলাতেও তারা একই রকম কথা বলে। আল্লাহ তাদের এই ধরণের কথার অনেক উর্ধ্বে।
যারা আল্লাহর অতি সুন্দর নাম ও আয়াতের মধ্যে ইলহাদ করে, তাদেরকে তিনি কঠোর আযাবের ধমক দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা সূরা আরাফের ১৮০ নং আয়াতে বলেন,
﴿وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ ۚسَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
‘‘আল্লাহ তা‘আলার অনেকগুলো সুন্দরতম নাম রয়েছে। সুতরাং তাঁকে সেই নামেই ডাকো এবং তাঁর নামসমূহের মধ্যে যারা বিকৃতি করে, তোমরা তাদেরকে বর্জন করো৷ তারা যা করে আসছে, তার ফল অবশ্যই তারা পাবে’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা ফুস্সিলাতের ৪০ নং আয়াতে আরো বলেন,
﴿إِنَّ الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي آيَاتِنَا لَا يَخْفَوْنَ عَلَيْنَا أَفَمَن يُلْقَىٰ فِي النَّارِ خَيْرٌ أَم مَّن يَأْتِي آمِنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۚ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ﴾
‘‘যারা আমার আয়াতসমূহের বিকৃতি (উল্টা অর্থ) করে, তারা আমার অগোচরে নয়৷ যাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে সে উত্তম? না যে কিয়ামতের দিন নিরাপদ অবস্থায় হাজির হবে সে উত্তম? তোমরা যা চাও করতে থাকো, আল্লাহ তোমাদের সব কাজ দেখছেন’’।
[3]. ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ তার আকীদা বিষয়ক কাসিদাহ নুনিয়ার মধ্যে এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এক অধ্যায়ে তিনি বলেছেন যে, জাহমিয়রা মুশরিকদের চেয়েও নিকৃষ্ট। নুনিয়ার অন্য একটি অনুচ্ছেদে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তাদের বিদআতগুলো কুফুরী পর্যন্ত পৌছে গেছে। নিঃসন্দেহে তাদের আকীদা ও আমলগুলো প্রমাণ করে যে, তারা মুসলিমদের আলেমদের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছে। তাদের নিকৃষ্ট আকীদার মধ্যে রয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা কথা বলেন না। আমাদের প্রশ্ন হলো, আল্লাহ তা‘আলা যদি কথা না বলেন, তাহলে কুরআন কার কালাম? জবাবে তারা বলেছে যে, কুরআন হলো অন্যান্য সৃষ্টির মতই একটি সৃষ্টি। যেমন মানুষ এক প্রকার সৃষ্টি। সুতরাং তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা বলা বিশেষণ নাকোচ করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সমস্ত প্রত্যাদেশকে মাখলুক বলেছে।
প্রকৃত কথা হলো কুরআন-হাদীছের বহু দলীল এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমদের ঐক্যমতে কুরআন মাখলুক নয়; বরং তা আল্লাহর কালাম। আল্লাহ তা‘আলা এর মাধ্যমে কথা বলেছেন। তার থেকেই কুরআন এসেছে এবং তার নিকটই ফিরে যাবে।
আল্লাহ তায়ালা কোথায়?
আল্লাহ তায়ালার সত্তাগত সিফাতসমূহ
আল্লাহ তা'আলার সত্তাগত সিফাত (ذاتي صفات) এমন গুণাবলি যা আল্লাহর সত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলো আল্লাহর পরিচয় ও মহিমাকে বোঝায়, যা তাঁর সত্তার অনন্যতা, বিশুদ্ধতা ও অপার ক্ষমতাকে প্রকাশ করে।
কুরআন, সহীহ হাদীস ও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের বক্তব্য সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
---
১. আল্লাহ তায়ালার চেহারা (وَجْهُ الله)
🔹 কুরআনে এসেছে:
﴿وَيَبْقَىٰ وَجْهُ رَبِّكَ ذُو ٱلْجَلَـٰلِ وَٱلْإِكْرَامِ﴾
"আর তোমার রবের চেহারাই স্থায়ী থাকবে, যিনি মহিমান্বিত ও সম্মানিত।"
— [সূরা আর-রাহমান, ৫৫:২৭]
🔹 আহলুস সুন্নাহর আকীদা: আল্লাহর চেহারা আছে, তবে তা সৃষ্টির চেহারার মতো নয়। আমরা এটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করি, কিন্তু কিভাবে — তা জানি না (بِلَا كَيْفٍ)। এটি তাঁর একটি সত্তাগত গুণ।
২. আল্লাহ তায়ালার চোখ (عين الله)
🔹 কুরআনে এসেছে:
﴿وَلِتُصْنَعَ عَلَىٰ عَيْنِي﴾
“এবং তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও।”
— [সূরা ত্বা-হা, ২০:৩৯]
🔹 আকীদা: আল্লাহর চোখ আছে, তবে সৃষ্টির মতো নয়। তিনি সবকিছু দেখেন, তাঁর ‘চোখ’ দ্বারা যাহা বোঝানো হয়েছে তা বাস্তবিক, তবে কিভাবে — তা জানা নেই।
---
৩. আল্লাহ তায়ালার দুই হাত (يَدَاهُ)
🔹 কুরআনে:
﴿بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ﴾
“বরং তাঁর দুই হাত প্রসারিত।”
— [সূরা আল-মায়েদাহ, ৫:৬৪]
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে:
يَطْوِي اللَّهُ السَّمَاوَاتِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ يَأْخُذُهُنَّ بِيَدِهِ الْيُمْنَى
“কিয়ামতের দিন আল্লাহ আসমানসমূহকে ভাঁজ করে ফেলবেন, তারপর তা তাঁর ডান হাতে নেবেন...”
— [সহীহ মুসলিম: ৬৯৪৪,
সহীহ বুখারী: ৭৪১১
حَدَّثَنَا أَبُو الْيَمَانِ، أَخْبَرَنَا شُعَيْبٌ، حَدَّثَنَا أَبُو الزِّنَادِ، عَنِ الأَعْرَجِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " يَدُ اللَّهِ مَلأَى لاَ يَغِيضُهَا نَفَقَةٌ، سَحَّاءُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ ـ وَقَالَ ـ أَرَأَيْتُمْ مَا أَنْفَقَ مُنْذُ خَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ، فَإِنَّهُ لَمْ يَغِضْ مَا فِي يَدِهِ ـ وَقَالَ ـ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ وَبِيَدِهِ الأُخْرَى الْمِيزَانُ يَخْفِضُ وَيَرْفَعُ ".
অর্থ: আবু হুরায়রাহ (রাদ্বি.) হতে বর্ণিত, আবু হুরায়রাহ (রাদ্বি.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আল্লাহ্র হাত পূর্ণ, রাতদিন খরচ করলেও তাতে কমতি আসে না। তিনি আরো বলেছেনঃ তোমরা কি দেখেছ? আসমান যমীন সৃষ্টি করার পর থেকে তিনি যে কত খরচ করেছেন, তা সত্ত্বেও তাঁর হাতে যা আছে, তাতে এতটুকু কমেনি। এবং নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তখন তাঁর আরশ পানির উপর ছিল। তাঁর অন্য হাতে আছে দাঁড়িপাল্লা, যা কখনও তিনি নিচে নামান আবার কখনও উপরে উঠান। (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৮৯৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৯০৭)
🔹 আকীদা: আল্লাহর দুই হাত আছে, সত্যভাবে আছে। কিন্তু তা সৃষ্টির হাতের সদৃশ নয়।
---
৪. আল্লাহ তায়ালার হাতের আঙুল
🔹 হাদীসে এসেছে:
“তাঁর হাতের আঙুলে বান্দার হৃদয়সমূহ রয়েছে।”
— [সহীহ মুসলিম, হাদীস: 6643 হাদীস একাডেমী]
🔹 আকীদা: আল্লাহর আঙুল আছে, এটা আমরা হাদীস থেকে জানি, কিন্তু কেমন — তা জানি না, এবং সৃষ্টি থেকে তুলনা করি না।
---
৫. আল্লাহ তায়ালার কোমর
🔹 রাসূল ﷺ বলেছেন
خَلَقَ اللهُ الْخَلْقَ، فَلَمَّا فَرَغَ مِنْهُ قَامَتِ الرَّحِمُ فَأَخَذَتْ بِحَقْوِ الرَّحْمَنِ فَقَالَ لَهَا مَهْ. قَالَتْ هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطِيْعَةِ. قَالَ أَلاَ تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ. قَالَتْ بَلَى يَا رَبِّ. قَالَ فَذَاكِ لَكِ. قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ اقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ (فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوْا فِى الأَرْضِ وَتُقَطِّعُوْا أَرْحَامَكُمْ).”
আল্লাহ তা‘আলা যখন সমস্ত সৃষ্টি জগতকে সৃষ্টি করলেন, তখন ‘রেহেম (আত্মীয়তা)’ উঠে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কোমর ধরল। আল্লাহ তা‘আলা জিজ্ঞেস করলেন, কি চাও? সে বলল, এটা হ’ল আত্মীয়তা ছিন্নকারী হ’তে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার স্থান! তিনি বললেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, যে তোমার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে, আমিও তাকে ছিন্ন করব? রেহেম বলল, জ্বী হ্যাঁ, রব্ব! তিনি বললেন, এটা তো তোমারই জন্য। অতঃপর আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, ইচ্ছা হ’লে পড়তে পার, ‘তবে কি (হে মুনাফিক সমাজ!) তোমরা আধিপত্য লাভ করলে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন সমূহকে ছিন্ন করবে”। (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭/২২; সহীহ বুখারী হা/৪৮৩০)
৬. আল্লাহ তায়ালার পা (قَدَمُ الله)
🔹 সহীহ হাদীস:
“জাহান্নাম বলতে থাকবে: ‘আরো আছে কি?’ অবশেষে আল্লাহ পা রাখবেন জাহান্নামে, তখন তা পূর্ণ হয়ে যাবে।”
— [সহীহ বুখারী, হাদীস: ৪৮৪৮; সহীহ মুসলিম]
🔹 আকীদা: আল্লাহর জন্য পা সাব্যস্ত, তবে তা সৃষ্টি থেকে ভিন্ন, এবং কিভাবে — তা অজানা।
---
🔸 সারাংশ:
আল্লাহর চেহারা, চোখ, হাত, আঙুল, পা — সবই বাস্তবিক, তবে সৃষ্টির মতো নয়।
এগুলো আল্লাহর জন্য যেমন উপযুক্ত তেমনই, কিভাবে — তা অজানা (بلا كيف).
কোন কিছু আল্লাহর সঙ্গে তুলনা করা যাবে না:
﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ﴾
— “তাঁর মতো কিছুই নয়।” (সূরা আশ-শূরা, ৪২:১১)
---
মালাইকাহ (ফেরেশতাগণ) সম্পর্কে সঠিক আক্বীদাহ
মালাইকাহ (ফেরেশতাগণ) সম্পর্কে সঠিক আক্বীদাহ
ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ঈমানের ছয়টি রুকনের অন্তর্ভুক্ত। ঈমান সম্পর্কে জিবরীল আলাইহিস সালামের প্রশ্নের জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
(أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ)
‘‘তুমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে (১) আল্লাহ পাকের উপর (২) তার ফেরেস্তাদের উপর (৩) তার কিতাবসমূহের উপর (৪) তার রসূলদের উপর (৫) আখেরাত বা শেষ দিবসের উপর এবং (৬) তাক্বদীরের ভালো-মন্দের উপর’’।[1]
কুরআনের অনেক আয়াতে ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনয়নের বিষয়টি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নের সাথে মিলিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ﴾
‘‘রসূল তার রবের পক্ষ হতে যে হিদায়াত নাযিল করা হয়েছে, তার প্রতি ঈমান এনেছেন। মুমিনগণ ঈমান এনেছেন। তারা সকলেই আল্লাহর প্রতি, তার ফেরেশতাদের প্রতি, কিতাবসমূহের প্রতি এবং রসূলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। তারা বলেন, আমরা রসূলদের একজনকে অন্যজন থেকে পার্থক্য করিনা। আর তারা বলেন, আমরা নির্দেশ শুনেছি এবং অনুগত হয়েছি। হে আমাদের প্রভু! আমরা গুনাহ মাফের জন্য তোমার কাছে প্রার্থনা করছি। আমরা তোমারই দিকে ফিরে যাবো’’। (সূরা আল বাকারা: ২৮৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ﴾
‘‘তোমাদের মুখম-ল পূর্ব বা পশ্চিম দিকে ফিরনোর মধ্যে কোনো পূণ্য নেই; বরং পূণ্য তার, যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে’’। (সূরা আল বাকারা: ১৭৭)
ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনয়নের তাৎপর্য হলো, অন্তর দিয়ে তাদের অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস করা। আরো বিশ্বাস করা যে, তারা আল্লাহর মর্যাদাশীল বান্দা। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তার ইবাদতের জন্য এবং তার আদেশ বাস্তবায়নের জন্য সৃষ্টি করেছেন। সে সঙ্গে আরো বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, বিভিন্ন প্রকার ফেরেশতা রয়েছে এবং তাদের বিভিন্ন গুণাবলীল রয়েছে। আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতে বলা হয়েছে যে, ফেরেশতাগণ বিভিন্ন কাজ-কর্ম ও দায়-দায়িত্ব পালন করে। আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাদের যে ফযীলত ও মর্যাদা রয়েছে, তার প্রতিও ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক।[2]
সহীহ মুসলিমের হাদীছে এসেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে নূর দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতাদের সম্মান ও মর্যাদার ব্যাপারে যেসব দলীল রয়েছে, তা থেকে নিম্নে কয়েকটি দলীল উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের সম্মানার্থে তাদেরকে নিজের দিকে সম্বন্ধ করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
﴿إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا﴾
‘‘নিশ্চয় আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ পাঠান। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তার প্রতি দুরূদ ও সালাম পাঠাও’’। (সূরা আহযাব: ৫৬)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ ﴾ ‘‘তারা সবাই আল্লাহর প্রতি ও তার ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا﴾
‘‘যারা কুফুরী করেছে, আল্লাহর প্রতি, তার ফেরেশতাদের প্রতি, তার কিতাবসমূহের প্রতি এবং তার রসূলদের প্রতি এবং পরকালের প্রতি, তারা বহুদূরের গোমরাহীতে পতিত হয়েছে’’। (সূরা নিসা: ১৩৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِلَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالَ فَإِنَّ اللَّهَ عَدُوٌّ لِلْكَافِرِينَ﴾
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তার ফেরেশতা, তার রসূলগণ, জিবরীল ও মীকাইলের শত্রু হবে স্বয়ং আল্লাহ সেই কাফেরদের শত্রু’’। (সূরা বাকারা: ৯৮)
আল্লাহ তা‘আলা তার সাক্ষ্যকে ফেরেশতাদের সাক্ষ্যের সাথে এবং নবীর প্রতি তার দুরূদ পাঠানোর সাথে ফেরেশতাদের দুরূদ পাঠানোকে একসাথে মিলিয়ে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿شَهِدَ اللّهُ أَنَّهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ وَالْمَلاَئِكَةُ﴾
‘‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই এবং ফেরেশতাগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ﴾ ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ পাঠান’’। (সূরা আহযাব: ৫৬)
আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মর্যাদাবান বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন তিনি বলেন, كِرَامٍ بَرَرَةٍ﴾ ﴿بِأَيْدِي سَفَرَةٍ ‘‘এ উপদেশ লিপিকারদের হস্ত দ্বারা লিপিবদ্ধ। যারা সম্মানিত ও পূণ্যবাণ’’। (সূরা আবাসা: ১৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ كِرَامًا كَاتِبِينَ يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ﴾
‘‘নিশ্চয় তোমাদের উপর সংরক্ষকগণ নিযুক্ত রয়েছেন। সম্মানিত লেখকবৃন্দ। তোমরা যা করো তারা তা জানে’’। (সূরা ইনফিতার: ১০-১২)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿بَلْ عِبَادٌ مُّكْرَمُونَ لا يَسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُمْ بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ ﴾ ‘‘তারা তো মর্যাদাশালী বান্দা। তারা তার সামনে অগ্রবর্তী হয়ে কথা বলেন না এবং শুধু তার হুকুমে কাজ করেন’’। (সূরা আম্বীয়া: ২৬-২৭)
আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে উর্ধ্বজগতের বাসিন্দা এবং নৈকট্যশীল বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
﴿لَّا يَسَّمَّعُونَ إِلَى الْمَلَإِ الْأَعْلَىٰ وَيُقْذَفُونَ مِن كُلِّ جَانِبٍ﴾
‘‘শয়তানরা উর্ধ্ব জগতের কিছু শ্রবণ করতে পারে না। এদের উপর সকল দিক থেকে উল্কা নিক্ষিপ্ত হয়’’। (সূরা সাফফাত: ৮) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿يَشْهَدُهُ الْمُقَرَّبُونَ﴾ ‘‘নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতারা এর দেখাশুনা করে’’। (সূরা মুতাফফিফীন: ২১) আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন যে, ফেরেশতাগণ তার আরশ বহন করে এবং সেটাকে ঘিরে রাখে’’। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿الَّذِينَ يَحْمِلُونَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيُؤْمِنُونَ بِهِ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِلَّذِينَ آَمَنُوا رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَحْمَةً وَعِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا وَاتَّبَعُوا سَبِيلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ﴾
‘‘আল্লাহর আরশের ধারক ফেরেশতাগণ এবং যারা আরশের চারপাশে হাজির থাকে তারা সবাই প্রশংসাসহ তাদের রবের পবিত্রতা বর্ণনা করে। তার প্রতি ঈমান আনয়ন করে এবং ঈমানদারদের জন্য দু‘আ করে। তারা বলে, হে আমাদের রব! তুমি তোমার রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সবকিছু পরিবেষ্টন করে আছো। তাই যারা তাওবা করেছে এবং তোমার পথ অনুসরণ করছে তাদেরকে মাফ করে দাও’’। (সূরা গাফের: ৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَتَرَى الْمَلَائِكَةَ حَافِّينَ مِنْ حَوْلِ الْعَرْشِ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَقُضِيَ بَيْنَهُمْ بِالْحَقِّ وَقِيلَ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ﴾
তুমি আরো দেখতে পাবে যে, ফেরেশতারা আরশের চারদিক বৃত্ত বানিয়ে তাদের রবের প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করছে। মানুষের মধ্যে ইনসাফের সাথে ফায়ছালা করে দেয়া হবে এবং ঘোষণা দেয়া হবে, সারা বিশ্ব-জাহানের রবের জন্যই সমস্ত প্রশংসা (সূরা যুমার: ৭৫)। আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের সম্মান বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, তারা তার নিকটবর্তী, তারা তার ইবাদত করে এবং তার পবিত্রতা বর্ণনা করে। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿إِنَّ الَّذِينَ عِنْدَ رَبِّكَ لَا يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِهِ وَيُسَبِّحُونَهُ وَلَهُ يَسْجُدُونَ﴾
‘‘তোমার রবের ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে অবস্থানকারী ফেরেশতাগণ কখনো নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে তার এবাদতে বিরত হয় না: বরং তারা তারই মহিমা ঘোষণা করে এবং তার সামনে সিজদাবনত হয়’’। (সূরা আরাফ: ২০৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَإِنِ اسْتَكْبَرُوا فَالَّذِينَ عِنْدَ رَبِّكَ يُسَبِّحُونَ لَهُ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَهُمْ لَا يَسْأَمُونَ﴾
কিন্তু তারা যদি অহংকার করে, তাতে কিছু যায় আসে না। যেসব ফেরেশতা তোমার রবের সান্নিধ্য লাভ করেছে তারা রাতদিন তার তাসবীহ বর্ণনা করছে এবং কখনো ক্লান্ত হয় না। (সূরা ফুস্সিলাত: ৩৮)
কাজ-কর্ম ও দায়-দায়িত্ব পালনের দিক থেকে ও ফেরেশতাগণ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত। তাদের মধ্য থেকে একদল ফেরেশতা আল্লাহর আরশ বহনকারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿الَّذِينَ يَحْمِلُونَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُ﴾ ‘‘আল্লাহর আরশের ধারক ফেরেশতাগণ এবং যারা আরশের চারপাশে হাজির থাকে’’। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿وَيَحْمِلُ عَرْشَ رَبِّكَ فَوْقَهُمْ يَوْمَئِذٍ ثَمَانِيَةٌ﴾ ‘‘সেদিন আটজন ফেরেশতা তাদের উপরে তোমার রবের আরশ বহন করবে’’। (সূরা হাক্কাহ: ১৭) তাদের একদল আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্যশীল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَنْ يَسْتَنْكِفَ الْمَسِيحُ أَنْ يَكُونَ عَبْدًا لِلَّهِ وَلَا الْمَلَائِكَةُ الْمُقَرَّبُونَ وَمَنْ يَسْتَنْكِفْ عَنْ عِبَادَتِهِ وَيَسْتَكْبِرْ فَسَيَحْشُرُهُمْ إِلَيْهِ جَمِيعًا﴾
‘‘মসীহ কখনো নিজে আল্লাহর এক বান্দা হবার ব্যাপারে লজ্জা অনুভব করে না এবং ঘনিষ্ঠতর ফেরেশতারাও একে নিজেদের জন্য লজ্জাকর মনে করে না। যে কেউ আল্লাহর ইবাদত করতে লজ্জাবোধ করবে এবং অহংকার করবে তাদের সবাইকে নিজের সামনে হাযির করবেন’’। (সূরা আন নিসা: ১৭২)
আরেকদল ফেরেশতা রয়েছেন, যারা জান্নাতের সংরক্ষণ এবং তাতে বসবাসকারীদের জন্য বিভিন্ন প্রকার নিয়ামত প্রস্ত্তত করার দায়িত্বে নিয়োজিত। আরেক শ্রেণীর ফেরেশতা জাহান্নাম ও তার অধিবাসীদেরকে শাস্তি দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত। এরা হলো জাহান্নামের দারোগা। তাদের মধ্যে ১৯ ফেরেশতা হলেন নেতৃস্থানীয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿عَلَيْهَا تِسْعَةَ عَشَرَ﴾ ‘‘সেখানে নিয়োজিত আছে উনিশজন কর্মচারী’’। (সূরা মুদ্দাছছির: ৩০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿وَنَادَوْا يَا مَالِكُ لِيَقْضِ عَلَيْنَا رَبُّكَ قَالَ إِنَّكُم مَّاكِثُونَ﴾ ‘‘তারা চিৎকার করে বলবে হে মালেক! তোমার রব আমাদেরকে চিরতরে নিঃশেষ করে দিন। সে বলবে, তোমাদের এভাবেই থাকতে হবে। (সূরা যুখরুফ: ৭৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَقَالَ الَّذِينَ فِي النَّارِ لِخَزَنَةِ جَهَنَّمَ ادْعُوا رَبَّكُمْ يُخَفِّفْ عَنَّا يَوْمًا مِّنَ الْعَذَابِ﴾
‘‘দোযখে নিক্ষিপ্ত এসব লোক জাহান্নামের প্রহরীদের বলবে, তোমাদের রবের কাছে দু‘আ করো তিনি যেন একদিনের জন্য আমাদের আযাব হালকা করেন’’। (সূরা গাফের: ৪৯) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَّا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ﴾
‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং নিজেদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করো যার জ্বালানী হবে মানুষ এবং পাথর। সেখানে নিয়োজিত আছে রুঢ় ও কঠোর স্বভাবের ফেরেশতারা। যারা কখনো আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে না এবং তাদেরকে যে নির্দেশ দেয়া হয় তাই করে’’। (সূরা তাহরীম: ৬)
আল্লাহ তা‘আলার কিছু ফেরেশতা রয়েছে, যারা দুনিয়াতে বনী আদমের হেফাযত করে। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِّن بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلَا مَرَدَّ لَهُ وَمَا لَهُم مِّن دُونِهِ مِن وَالٍ﴾
‘‘মানুষের জন্য তার সামনে ও পেছনে একের পর এক পাহারাদার নিযুক্ত রয়েছে, যারা আল্লাহর হুকুমে তার হেফাযত করছে। নিশ্চয় আল্লাহ ততোক্ষণ পর্যন্ত কোনো জাতির অবস্থা বদলান না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের স্বভাব-চরিত্র বদলে ফেলে। আর আল্লাহ যখন কোনো জাতির অকল্যাণ করার ফায়ছালা করেন তখন তা প্রতিহত করার কেউ নেই এবং তিনি ছাড়া তাদের কোনো সাহায্যকারী নেই’’। (সূরা আর রা’দ: ১১)
অর্থাৎ তার সাথে ফেরেশতা নিযুক্ত রয়েছে। তারা তাকে তার সামনে ও পেছনে রক্ষণাবেক্ষণ করে। কিন্তু যখন আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত ফায়ছালা চলে আসে তখন তারা তাকে ছেড়ে চলে যায়। ফেরেশতাদের একদল বান্দাদের আমল সংরক্ষণ করা ও লেখার দায়িত্বে নিয়োজিত। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ مَّا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ﴾
‘‘দু’জন লেখক তার ডান ও বাম দিকে বসে সবকিছু লিপিবদ্ধ করছে। এমন কোনো শব্দ তার মুখ থেকে বের হয় না, যা সংরক্ষিত করার জন্য একজন রক্ষক সদা প্রস্ত্তত থাকে না’’। (সূরা কাফ: ১৭-১৮) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ كِرَامًا كَاتِبِينَ يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ﴾
‘‘অথচ তোমাদের উপর সংরক্ষকগণ নিযুক্ত রয়েছে। সম্মানিত লেখকবৃন্দ। তোমরা যা করো, তারা তা জানে’’। (সূরা ইনফিতার: ১০-১১) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
(يَتَعَاقَبُونَ فِيكُمْ مَلَائِكَةٌ بِاللَّيْلِ وَمَلَائِكَةٌ بِالنَّهَارِ وَيَجْتَمِعُونَ فِي صَلَاةِ الْفَجْرِ وَصَلَاةِ الْعَصْرِ ثُمَّ يَعْرُجُ الَّذِينَ بَاتُوا فِيكُمْ فَيَسْأَلُهُمْ وَهُوَ أَعْلَمُ بِهِمْ كَيْفَ تَرَكْتُمْ عِبَادِي فَيَقُولُونَ تَرَكْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّونَ وَأَتَيْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّونَ)
‘‘তোমাদের নিকট রাতে একদল ফেরেশতা এবং দিনে একদল ফেরেশতা পালাক্রমে আগমন করে। তারা ফজর ও আসরের নামাযের সময় একসাথে একত্রিত হয়। অতঃপর তোমাদের কাছে যে দলটি ছিল, তারা উপরে উঠে যায়। মহান আল্লাহ জানা সত্ত্বেও তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, আমার বান্দাদেরকে কি অবস্থায় ছেড়ে এসেছো? তারা বলেন, আমরা তাদেরকে সালাত অবস্থায় ছেড়ে এসেছি এবং যখন তাদের কাছে গিয়েছিলাম, তখন তারা নামাযেই ছিল’’।
সুতরাং মানুষের সাথে এক শ্রেণীর ফেরেশতা রয়েছে, যারা তাকে কষ্টদায়ক জিনিস থেকে হেফাযত করে। আরেক শ্রেণীর ফেরেশতা রয়েছে, যারা তার আমলসমূহ সংরক্ষণ করে এবং তার মুখ থেকে যা কিছু প্রকাশিত হয়, তা সংরক্ষণ করে। আল্লাহ তা‘আলার ফেরেশতাদের মধ্যে এমন ফেরেশতা রয়েছে, যিনি গর্ভাশয় ও শুক্রকীটের দায়িত্বে নিয়োজিত। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের হাদীছে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّ أَحَدَكُمْ يُجْمَعُ خَلْقُهُ فِي بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا نطفة، ثُمَّ يَكُونُ عَلَقَةً مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ يَكُونُ مُضْغَةً مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ يرسل إليه الملك فينفخ فيه الروح وَيُؤْمَرُ بِأَرْبَعِ كَلِمَاتٍ يكتب رزقه وَأَجَلَهُ وعَمَلَهُ وَشَقِيٌّ أَوْ سَعِيدٌ
‘‘তোমাদের কারো সৃষ্টির অবস্থা এ যে, সে তার মায়ের পেটে প্রথমে চল্লিশ দিন বীর্য আকারে সঞ্চিত থাকে। পরবর্তী চল্লিশ দিনে সেটা জমাট রক্তে পরিণত হয়। এরপর আরো চল্লিশ দিনে সেটা মাংশপিন্ডে রূপান্তরিত হয়। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। তিনি তাতে রূহ ফুঁকে দেন। এসময় তাকে চারটি বিষয় লেখার নির্দেশ দেয়া হয়: ( ১) সে কী পরিমাণ রিযিক পাবে। (২) বয়স কত হবে। (৩) কর্ম কি হবে এবং (৪) সে সৌভাগ্যবান হবে না হতভাগা হবে’’।[3]
ফেরেশতাদের মধ্য থেকে একদল ফেরেশতা বনী আদমের রূহ কবযের দায়িত্বশীল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ وَيُرْسِلُ عَلَيْكُمْ حَفَظَةً حَتَّىٰ إِذَا جَاءَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ تَوَفَّتْهُ رُسُلُنَا وَهُمْ لَا يُفَرِّطُونَ﴾
‘‘তিনি নিজের বান্দাদের উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান এবং তোমাদের উপর রক্ষক নিযুক্ত করে পাঠান। অবশেষে যখন তোমাদের কারোর মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয় তখন তার প্রেরিত ফেরেশতারা তার প্রাণ বের করে নেয় এবং নিজেদের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তারা সামান্যতম শৈথিল্য দেখায়না’’। (সূরা আল আনআম: ৬১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿قُلْ يَتَوَفَّاكُم مَّلَكُ الْمَوْتِ الَّذِي وُكِّلَ بِكُمْ ثُمَّ إِلَىٰ رَبِّكُمْ تُرْجَعُونَ﴾
‘‘বলে দাও, মৃত্যুর ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে, যাকে তোমাদের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। অতঃপর তোমাদেরকে তোমাদের রবের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে’’। (সূরা সাজদাহ: ১১)
সুতরাং মালাকুল মাওতের জন্য ফেরেশতাদের মধ্য থেকে সহযোগী রয়েছে। তারা বান্দার শরীর থেকে রূহ বের করে। তারা যখন রূহকে কণ্ঠনালী পর্যন্ত আনয়ন করে, তখন মালাকুল মাওত নিজের কবযায় নিয়ে নেয়। মোটকথা আল্লাহ তা‘আলা উর্ধ্বজগৎ ও নিম্নজগতে বহু ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন। তারা তার অনুমতি, আদেশ ও ইচ্ছায় উভয় জগতের সকল কাজ-কর্ম পরিচালনা করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿بَلْ عِبَادٌ مُّكْرَمُونَ لَا يَسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُم بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ﴾ ‘‘তারা তো মর্যাদাশালী বান্দা। তারা তার সামনে অগ্রবর্তী হয়ে কথা বলেন না এবং শুধু তার হুকুমে কাজ করেন’’। (সূরা আন্বীয়া: ২৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ لَّا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ﴾
‘‘তারা কখনো আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে না এবং তাদেরকে যে নির্দেশ দেয়া হয় তাই পালন করে’’। (সূরা তাহরীম: ৬) এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা কখনো কখনো ফেরেশতাদের দিকেই ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার সম্বন্ধ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿ فَالْمُدَبِّرَاتِ أَمْرًا ﴾ ‘‘অতঃপর তারা সকল বিষয়ের কাজ পরিচালনা করেন’’। (সূরা নাযিআত: ৫) আবার কখনো কখনো আল্লাহ তা‘আলা সেটাকে নিজের দিকে সম্বন্ধ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الْأَرْضِ ثُمَّ يَعْرُجُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ أَلْفَ سَنَةٍ مِّمَّا تَعُدُّونَ﴾
‘‘তিনি আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত যাবতীয় বিষয় পরিচালনা করেন এবং এ পরিচালনার বৃত্তান্ত উপরে তার কাছে উঠানো হয় এমন একদিনে যার পরিমাণ তোমাদের গণনায় এক হাজার বছর’’। (সূরা সাজদাহ: ৫)
সুতরাং ফেরেশতা হলো আল্লাহ তা‘আলা ও তার সৃষ্টির মধ্যে দূত স্বরূপ। তারা তার আদেশ-নিষেধ সৃষ্টির নিকট পৌঁছে দেয়। আর الملك ফেরেশতা নামটির অর্থই হলো দূত।[4] কেননা الملك শব্দটি ألوكة থেকে গৃহীত। ألوكة শব্দটি الرسالة অর্থে ব্যবহৃত হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿الْحَمْدُ لِلَّهِ فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ جَاعِلِ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا أُولِي أَجْنِحَةٍ مَّثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ يَزِيدُ فِي الْخَلْقِ مَا يَشَاءُ إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর নির্মাতা এবং ফেরেশতাদেরকে বাণীবাহক নিয়োগকারী। যাদের দুই দুই তিন তিন ও চার চারটি ডানা[5] আছে। তিনি নিজের মধ্যে যা চান বৃদ্ধি করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব জিনিসের উপর শক্তিশালী’’। (সূরা ফাতির: ১)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,﴿وَالْمُرْسَلَاتِ عُرْفًا﴾ ‘‘শপথ ফেরেশতাদের, যারা একের পর এক প্রেরিত হয়’’। (সূরা মুরসালাত: ১)
সুতরাং এরা হলো আল্লাহ তা‘আলার ঐসব সৃষ্টিগত আদেশ বাস্তবায়নকারী ফেরেশতা, যা দ্বারা আসমান-যমীনের সবকিছুর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করা হয়। সেই সঙ্গে তারা আল্লাহ তা‘আলার শরী‘আত গত আদেশ নিয়েও মানব রসূলদের কাছে আগমন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يُنَزِّلُ الْمَلَائِكَةَ بِالرُّوحِ مِنْ أَمْرِهِ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ أَنْ أَنذِرُوا أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاتَّقُونِ﴾
‘‘তিনি তার বান্দাদের মধ্য থেকে যার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় নির্দেশে অহীসহ ফেরেশতাদের নাযিল করেন, এই মর্মে সতর্ক করার জন্য যে, আমি ছাড়া তোমাদের আর কোনো সত্য মাবুদ নেই। কাজেই তোমরা আমাকেই ভয় করো’’। (সূরা আন নাহাল: ২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ﴾
‘‘আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য থেকেও বাণীবাহক বাছাই করেন এবং মানুষদের মধ্য থেকেও। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা আল হজ: ৭৫)
ফেরেশতাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলেন জিবরীল আলাইহিস সালাম। তিনি অহীর দায়িত্বশীল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِنَّهُ لَتَنزِيلُ رَبِّ الْعَالَمِينَ نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ عَلَىٰ قَلْبِكَ لِتَكُونَ مِنَ الْمُنذِرِينَ بِلِسَانٍ عَرَبِيٍّ مُّبِينٍ﴾
‘‘এটি রববুল আলামীনের নাযিল করা কিতাব। একে নিয়ে আমানতদার রূহ অবতরণ করেছে তোমার হৃদয়ে, যাতে তুমি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হও। পরিস্কার আরবী ভাষায়’’। (সূরা শুআরা: ১৯২-১৯৫) আল্লাহ তা‘আলা সূরা নাহালের ১০২ নং আয়াতে আরো বলেন,
﴿قُلْ نَزَّلَهُ رُوحُ الْقُدُسِ مِن رَّبِّكَ بِالْحَقِّ ﴾‘‘বলো, একে তো রূহুল কুদুছ সত্যসহকারে তোমার রবের পক্ষ থেকে পর্যায়ক্রমে নাযিল করেছে’’।
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে বিভিন্ন আকার-আকৃতি ধারণ করার ক্ষমতা দিয়েছেন। তারা ইবরাহীম ও লুত আলাইহিস সালামের নিকট মেহমানের বেশে আগমন করেছিলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট জিবরীল আসতেন বিভিন্ন আকৃতিতে। কখনো আসতেন দিহইয়া কালবীর আকৃতিতে, কখনো আসতেন গ্রাম্য লোকের আকৃতিতে আবার কখনো আসতেন তার আসল আকৃতিতে যেভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেভাবেই। দু’বার এমনটি হয়েছিল। জিবরীল অন্য আকৃতিতে আসার কারণ হলো, মানুষ ফেরেশতাদেরকে আসল আকৃতিতে দেখার ক্ষমতা রাখে না। মুশরিকরা যখন আবেদন করেছিল, আল্লাহ তা‘আলা যেন তাদের কাছে ফেরেশতা পাঠান, তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَقَالُوا لَوْلَا أُنزِلَ عَلَيْهِ مَلَكٌ وَلَوْ أَنزَلْنَا مَلَكًا لَّقُضِيَ الْأَمْرُ ثُمَّ لَا يُنظَرُونَ وَلَوْ جَعَلْنَاهُ مَلَكًا لَّجَعَلْنَاهُ رَجُلًا وَلَلَبَسْنَا عَلَيْهِم مَّا يَلْبِسُونَ﴾
তারা বলে, তার কাছে ফেরেশতা পাঠানো হয় না কেন? যদি ফেরেশতা পাঠাতাম, তাহলে ফায়সালা হয়ে যেতো, তখন তাদেরকে আর কোনো অবকাশই দেয়া হতোনা। যদি ফেরেশতা পাঠাতাম তাহলেও তাকে মানুষের আকৃতিতেই পাঠাতাম এবং তাদেরকে ঠিক তেমনি সংশয়ে লিপ্ত করতাম যেমন তারা এখন লিপ্ত রয়েছে (সূরা আল আনআম: ৮-৯)
অর্থাৎ মানুষের কাছে যদি ফেরেশতা রসূল পাঠাতাম, তাহলে ফেরেশতা মানুষের আকৃতিতেই আসতেন। যাতে করে মানুষেরা তার সাথে কথা বলতে পারে এবং তার কাছ থেকে আল্লাহ তা‘আলার বাণী গ্রহণ করে উপকৃত হতে পারে। কেননা প্রত্যেক প্রকার সৃষ্টিই সমজাতীয় সৃষ্টির সাথে মিশতে পারে, ঘনিষ্টতা ও সখ্যতা তৈরী করতে অভ্যস্ত এবং অন্য প্রকৃতির সৃষ্টি থেকে দূরে সরে যায়। ফেরেশতা সম্পর্কে এতটুকু আলোচনাকেই যথেষ্ট মনে করছি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে বুঝার তাওফীক দিন। আমীন।
[1]. ছহীহ মুসলিম ৮, অধ্যায়: কিতাবুল ঈমান।
[2]. কুরআন ও সহীহ হাদীছের আলোকে ফেরেশতাদের আরো কিছু গুণাগুণ, কাজ-কর্ম ও দায়িত্ব-কর্তব্যের বর্ণনা নিম্নে পেশ করা হলো,
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿فَالْمُدَبِّرَاتِ أَمْرًا﴾ ‘‘এরপর আল্লাহর হুকুমে সকল বিষয়ের কাজ পরিচালনা করে’’। (সূরা নাযিআত, ৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿فَالْمُقَسِّمَاتِ أَمْرًا﴾ ‘‘অতঃপর একটি বড় জিনিস বন্টনকারী’’। (সূরা যারিয়াত, ৪) ঈমানদার ও রাসূলদের অনুসারীদের নিকট এরা হচ্ছেন ফেরেশতা। যারা সৃষ্টিকর্তা ও নবী-রাসূলদেরকে অস্বীকার করে, তারা বলে থাকে যে, উক্ত আয়াত দু’টিতে তারকার কথা বলা হয়েছে।
কুরআন ও সুন্নাহয় বিভিন্ন প্রকার ফেরেশতার কথা বলা হয়েছে। সেই সাথে তাদের উপর বিভিন্ন প্রকার মাখলুকের দায়িত্বও অর্পন করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা পাহাড়ের দায়িত্বে ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। মেঘমালা ও বৃষ্টি পরিচালনার জন্য ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। মাতৃগর্ভে শিশুর দায়িত্বে ফেরেশতা নিয়োগ করেছেন। সে শুক্রবিন্দু থেকে শুরু করে শিশুর গঠন পর্যন্ত যাবতীয় কাজ পরিচালনা করে। বান্দা যেই আমল করে, তা সংরক্ষণ করার জন্য এবং লিখে রাখার জন্য ফেরেশতা নিয়োগ করেছেন। মৃত্যুর জন্য ফেরেশতা নিয়োগ করেছেন। কবরে প্রশ্ন করার জন্য ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। মহা শুণ্যের গ্রহ-নক্ষত্রের জন্য ফেরেশতা নিয়োগ করেছেন। তারা তা ঘুরান ও পরিচালনা করেন। চন্দ্র-সূর্যের নিয়ন্ত্রণের জন্য ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। জাহান্নাম, জাহান্নামের আগুন জ্বালানো, জাহান্নামীদেরকে শাস্তি দেয়া এবং জাহান্নামের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার জন্য ফেরেশতা নিয়োগ করেছেন। জান্নাত, জান্নাতের পরিচালনা, তাতে বৃক্ষাদি লাগানো এবং তাতে বিভন্ন প্রকার নিয়ামত স্থাপন করার জন্য ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। সুতরাং ফেরেশতারা আল্লাহর সর্বাধিক বড় সৈনিক। তাদের মধ্যে রয়েছে এমন সব ফেরেশতা, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿وَالْمُرْسَلَاتِ عُرْفًا﴾ ‘‘শপথ ফেরেশতাদের, যারা একের পর এক প্রেরিত হয়। (সূরা মুরসালাত: ১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿وَالنَّاشِرَاتِ نَشْرًا (৩) فَالْفَارِقَاتِ فَرْقًا (৪) فَالْمُلْقِيَاتِ ذِكْرًا﴾ ‘‘শপথ ঐ সমস্ত ফেরেশতাগণের, যারা মেঘমালাকে বহন করে নিয়ে ছড়িয়ে দেয়। তারপর তাকে ফেঁড়ে বিচ্ছিন্ন করে। অতঃপর মানুষের মনে আল্লাহর স্মরণ জাগিয়ে দেয়’’। (সূরা মুরসালাত: ৩-৫) ফেরেশতাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,﴿وَالنَّازِعَاتِ غَرْقًا
(১) وَالنَّاشِطَاتِ نَشْطًا (২) وَالسَّابِحَاتِ سَبْحًا (৩) فَالسَّابِقَاتِ سَبْقًا﴾ ‘‘সেই ফেরেশতাদের কসম! যারা ডুব দিয়ে টানে এবং ঐ সমস্ত ফেরেশতার কসম, যারা খুব আস্তে আস্তে বের করে নিয়ে যায়। আর সেই ফেরেশতাদেরও শপথ! যারা বিশ্বলোকে দ্রুত গতিতে সাঁতরে চলে অতঃপর বারবার সবেগে এগিয়ে যায়’’। (সূরা নাযিআত: ১-৪) আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের কাজ সম্পর্কে আরো বলেন, ﴿وَالصَّافَّاتِ صَفًّا (১) فَالزَّاجِرَاتِ زَجْرًا (২) فَالتَّالِيَاتِ ذِكْرًا﴾ ‘‘সারিবদ্ধভাবে দ-ায়মানদের কসম, তারপর যারা ধমক ও অভিশাপ দেয়। তারপর তাদের কসম যারা উপদেশবাণী শুনায়’’। (সূরা সাফফাত: ১-৩)
ফেরেশতাদের মধ্যে আরো রয়েছে একদল রহমতের ফেরেশতা। রয়েছে আযাবের ফেরেশতা। আরো এমন ফেরেশতা রয়েছে, যাদেরকে আরশ বহন করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আরো এমন ফেরেশতা রয়েছে, যাদেরকে সালাত কায়েম, তাসবীহ পাঠ এবং আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনার মাধ্যমে আসমানসমূহ আবাদ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে আরো অনেক ফেরেশতা, যাদের সংখ্যা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানেনা। الملَك শব্দটির লাম বর্ণে যবর দিয়ে পড়লে এমন অর্থ প্রদান করে যাতে বুঝা যায় যে, তারা সেই বার্তাবাহক অর্থে ব্যবহৃত, যারা বার্তা প্রেরকের বার্তা পৌঁছিয়ে দেয়। তাদের হাতে কিছু নেই। বরং সকল কিছুর চাবিকাঠি পরাক্রমশালী একক সত্তার হাতে। তারা শুধু তাঁর আদেশ বাস্তবায়ন করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿بَلْ عِبَادٌ مُّكْرَمُونَ لَا يَسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُم بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ﴾ ‘‘তারা তো মর্যাদাশালী বান্দা৷ তারা তাঁর সামনে অগ্রবর্তী হয়ে কথা বলেন না এবং শুধু তাঁর হুকুমে কাজ করেন’’। (সূরা আন্বীয়া: ২৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ﴾ ‘‘যা কিছু মানুষের সামনে আছে তা তিনি জানেন এবং যা কিছু তাদের অগোচরে আছে সে সম্পর্কেও তিনি অবগত’’। (সূরা বাকারা: ২৫৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ﴾ ‘‘যাদের পক্ষে সুপারিশ শুনতে আল্লাহ সম্মত তাদের পক্ষে ছাড়া আর কারো সুপারিশ তারা করে না এবং তারা তাঁর ভয়ে থাকে ভীত-সন্ত্রস্ত’’। (সূরা আন্বীয়া: ২৮) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,﴿يَخَافُونَ رَبَّهُمْ مِنْ فَوْقِهِمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ﴾ ‘‘তারা ভয় করে নিজেদের রবকে যিনি তাদের উপরে আছেন এবং যা কিছু হুকুম দেয়া হয় তারা তাই করে’’। (সূরা নাহাল: ৫০)
সুতরাং ফেরেশতারা হচ্ছেন আল্লাহর সম্মানিত বান্দা। তাদের মধ্যে কতক ফেরেশতা সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান। কেউবা তাসবীহ পাঠে মশগুল। তাদের প্রত্যেকের জন্যই রয়েছে সুনির্দিষ্ট দাড়াবার স্থান। তিনি তা অতিক্রম করতে পারেন না। তিনি আদিষ্ট কর্মে ব্যস্ত রয়েছেন। সেই কাজ করতে কোন প্রকার ত্রুটি করেন না এবং তাঁকে যেই কাজের আদেশ করা হয়েছে, তার সীমাও লংঘন করেন না। যারা আল্লাহর নিকটবর্তী, তাদের মর্যাদা সর্বোচ্চ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿لَا يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِهِ وَلَا يَسْتَحْسِرُونَ يُسَبِّحُونَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ لَا يَفْتُرُونَ﴾ ‘‘তারা নিজেদেরকে বড় মনে করে তাঁর এবাদত থেকে বিমুখ হয় না এবং না ক্লান্ত হয়। দিনরাত তাঁর প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণা করতে থাকেন, বিরাম বা বিশ্রাম নেন না’’। (সূরা আম্বীয়া: ১৯-২০)
ফেরেশতাদের প্রধান ও নেতা হলেন তিনজন। জিবরীল, মীকাঈল এবং ইসরাফীল। তারা সকল মানুষ, প্রাণী, জীব ও উদ্ভিদের হায়াতের দায়িত্বপ্রাপ্ত। জিবরীল (আঃ) অহীর দায়িত্বপ্রাপ্ত। অহীর মাধ্যমেই রূহ এবং অন্তর জীবিত হয়। মিকাঈল বৃষ্টির দায়িত্বপ্রাপ্ত। বৃষ্টির মাধ্যমে যমীন, উদ্ভিদ এবং প্রাণী জগৎ জীবিত হয়। ইসরাফীল শিঙ্গায় ফুৎকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত। এর মাধ্যমে সৃষ্টি মৃত্যুর পর পুনঃজীবন ফেরত পাবে। সুতরাং ফেরেশতারা হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি ও আদেশের ক্ষেত্রে আল্লাহর দূত। তারা তাঁর মাঝে এবং তাঁর বান্দাদের মাঝে দূত স্বরূপ। তারা আল্লাহর নিকট থেকে সৃষ্টি জগতের সকল প্রামেত্ম তাঁর আদেশ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে অবতরণ করে এবং তাঁর নিকট উন্নীত হয়। ফেরেশতাদের ভারে আসমানসমূহ কড়কড় আওয়াজ করে। আওয়াজ করাই এগুলোর জন্য সমীচিন। আসমানে চার আঙ্গুল পরিমাণ জায়গাও খালী নেই, যাতে কোনো না কোনো ফেরেশতা দাঁড়িয়ে, কিংবা রুকু অবস্থায় অথবা সিজদারত অবস্থায় আল্লাহর এবাদতে মশগুল নয়। প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা বাইতুল মা’মুরে প্রবেশ করে। তাদের কেউ সেটাতে দ্বিতীয়বার প্রবেশের সুযোগ পাবে না। কুরআন মজীদ বিভিন্ন প্রকার ফেরেশতা এবং তাদের বিভিন্ন পদ মর্যাদার আলোচনায় ভরপূর। কোথাও কোথাও আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নামের সাথে ফেরেশতার নাম যুক্ত করে উল্লেখ করেছেন এবং আল্লাহর সালাতকে ফেরেশতাদের সালাতের সাথে মিলিয়ে উল্লেখ করেছেন। আবার কখনো কখনো সম্মান জনক স্থানের দিকে তাদেরকে সম্বোধিত করেছেন। আবার কখনো উল্লেখ করেছেন যে, ফেরেশতারা আরশকে ঘিরে আছে এবং তারা আরশ বহন করে আছে। আবার কখনো উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা পাপ কাজ করা হতে মুক্ত। কখনো বলা হয়েছে যে, তারা সম্মানিত, নৈকট্যশীল, তারা উপরে উঠে, তারা পবিত্র, শক্তিধর এবং একনিষ্ঠ। (আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)
[3]. সহীহ মুসলিম, হা/২৬৪৩, তিরমিযী, হা/২১৩৭, সহীহ।
[4] . এর অর্থ এও হতে পারে যে ফেরেশতারা মহান আল্লাহ তা‘আলা ও নবী-রাসূলদের মধ্যে বার্তা পৌঁছাবার কাজ করেন। সে হিসাবে তারা আল্লাহর দূত। আবার এ অর্থও হতে পারে যে, সমগ্র বিশ্ব-জাহানে মহাশক্তির অধিকারী আল্লাহর বিধান নিয়ে যাওয়া এবং সেগুলো প্রবর্তন করা ফেরেশতাদেরই কাজ। এ কথা উল্লেখ করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ফেরেশতাদেরকে মুশরিকরা দেব-দেবীতে পরিণত করেছিল অথচ এদের মর্যাদা এক আল্লাহর একান্ত অনুগত খাদেমের চেয়ে মোটেই বেশি নয়। বাদশাহর খাদেমরা যেমন তার হুকুম তামিল করার জন্য দৌড়াদৌড়ি করে থাকে ঠিক তেমনি এ ফেরেশতারাও বিশ্ব-জাহানের প্রকৃত শাসনকর্তার হুকুম পালন করার জন্য উড়ে চলতে থাকেন। এ খাদেমদের কোনো ক্ষমতা নেই। সমস্ত ক্ষমতা রয়েছে আসল শাসনকর্তার হাতে। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।
[5]. ফেরেশতাদের হাত ও ডানার অবস্থা ও ধরণ জানার কোনো মাধ্যম আমাদের কাছে নেই। কিন্তু এর অবস্থা ও ধরণ বর্ণনা করার জন্য আল্লাহ যখন এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন যা মানুষের ভাষায় পাখিদের হাত ও ডানার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে তখন অবশ্যই আমাদের ভাষার এ শব্দকেই আসল অবস্থা ও ধরণ বর্ণনার নিকটতর বলে ধারণা করা যেতে পারে। দুই দুই, তিন তিন ও চার চার ডানার কথা বলা থেকে বুঝা যায় যে, বিভিন্ন ফেরেশতাকে আল্লাহ বিভিন্ন রকম শক্তি দান করেছেন এবং যাকে দিয়ে যে কাজ করতে চান তাকে সেরকম দ্রুতগতি ও কর্মশক্তি দান করেছেন।
আসমানী কিতাবসমূহ সম্পর্কে সহীহ আক্বীদাহ
আসমানী কিতাবসমূহ সম্পর্কে সহীহ আক্বীদাহ
আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ঈমানের অন্যতম রুকন। আসমানী কিতাবগুলোর প্রতি ঈমান আনয়নের অর্থ হলো দৃঢ় বিশ্বাস করা যে এগুলো সত্য ও সঠিক। আরো বিশ্বাস করা যে, এগুলো আল্লাহ তা‘আলার কালাম। তাতে রয়েছে হিদায়াত, নূর এবং যাদের প্রতি এগুলো নাযিল করা হয়েছে, তাদের জন্য এগুলোই যথেষ্ট।
আসমানী কিতাবগুলো থেকে আল্লাহ তা‘আলা যেগুলোর নাম উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর প্রতি আমরা বিশ্বাস স্থাপন করি। যেমন কুরআন, তাওরাত, ইঞ্জিল ও যবুর। আর যেগুলোর নাম আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে উল্লেখ করেননি, সেগুলোর প্রতিও বিশ্বাস করি। কেননা আল্লাহ তা‘আলার আরো অনেক কিতাব রয়েছে, যা তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানে না।
মানুষের বিবেক-বুদ্ধি যেহেতু সীমিত এবং সেটা দ্বারা ক্ষতিকর ও কল্যাণকর বস্তুর মধ্যে পার্থক্য মোটামুটিভাবে বুঝতে সক্ষম হলেও তারা কল্যাণকর ও ক্ষতিকর বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে জানতে সক্ষম নয়। তাই তাদের জন্য আসমান থেকে কিতাব পাঠানোর বিশেষ প্রয়োজন ছিল। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি দয়াশীল হয়ে নবী-রসূলদের মাধ্যমে অনেক কিতাব পাঠিয়েছেন।
সে সঙ্গে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তা-চেতনার উপর প্রবৃত্তির প্রেরণা প্রাধান্য লাভ করে। প্রবৃত্তির তাড়না ও পার্থিব হীন স্বার্থ তাদের বিবেক-বুদ্ধি নিয়ে খেল-তামাশা করে। সুতরাং মানুষকে যদি তাদের সীমিত বিবেক-বুদ্ধির উপর ছেড়ে দেয়া হতো, তাহলে তারা পথভ্রষ্ট হতো। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলার হিকমত ও রহমতের দাবি অনুযায়ী নির্বাচিত রসূলদের উপর তিনি এ কিতাবগুলো নাযিল করেছেন। যাতে তারা মানুষের জন্য এসব কিতাবের দিক-নির্দেশনা বাতলে দিতে পারেন, তাতে যেসব ইনসাফপূর্ণ হুকুম-আহকাম, উপকারী উপদেশ এবং মানবতার সংশোধনের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে আগত আদেশ-নিষেধগুলো সবিস্তারে বর্ণনা করতে পারেন। মানব জাতির পিতা আদমকে যখন জান্নাত থেকে যমীনে নামিয়ে দেয়া হলো, তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدًى فَمَن تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ﴾
‘‘এরপর যখন আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত তোমাদের কাছে পেঁŠছাবে তখন যারা আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের জন্য থাকবে না কোনো ভয় এবং তারা চিন্তিতও হবে না’’। (সূরা আল বাকারা: ৩৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿يَا بَنِي آدَمَ إِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ رُسُلٌ مِّنكُمْ يَقُصُّونَ عَلَيْكُمْ آيَاتِي فَمَنِ اتَّقَىٰ وَأَصْلَحَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ﴾
‘‘হে বনী আদম! তোমাদের কাছে যখন তোমাদের মধ্য থেকে রসূলগণ এসে তোমাদেরকে আমার আয়াতসমূহ বিবৃত করে, তখন যারা সতর্ক হবে এবং নিজেকে সংশোধন করবে, তাদের কোনো ভয় থাকবেনা এবং চিন্তিতও হবে না’’। (সূরা আরাফ: ৩৫)
আসমানী কিতাবগুলোর ব্যাপারে লোকেরা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক শ্রেণীর লোক সমস্ত আসমানী কিতাবকে অস্বীকার করেছে। নবী-রসূলদের দুশমন কাফের, মুশরিক ও দার্শনিকরা এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
আরেক শ্রেণীর লোক সমস্ত আসমানী কিতাবেই বিশ্বাস করে। এরা হলো ঐসব মুমিন, যারা সমস্ত নবী-রসূল এবং তাদের উপর অবতীর্ণ সমস্ত কিতাবের উপর ঈমান আনয়ন করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ﴾
‘‘রসূল তার রবের পক্ষ হতে যে হিদায়াত নাযিল করা হয়েছে, তার প্রতি ঈমান এনেছেন। মুমিনগণও ঈমান এনেছেন। তারা সকলেই আল্লাহর প্রতি, তার ফেরেশতাদের প্রতি, তার কিতাবসমূহের প্রতি এবং তার রসূলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে। তারা বলে, আমরা রসূলদের একজনকে অন্যজন থেকে পৃথক করিনা। আর তারা বলে, আমরা নির্দেশ শুনেছি এবং অনুগত হয়েছি। হে আমাদের প্রভু! আমরা গুনাহ মাফের জন্য তোমার কাছে প্রার্থনা করছি। আমরা তোমার দিকেই ফিরে যাবো’’। (সূরা বাকারা: ২৮৫)
আরেক শ্রেণীর লোক কিছু আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে এবং বাকিগুলোর প্রতি কুফুরী করেছে। এরা হলো ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টান এবং তাদের অনুসারীগণ। তাদেরকে যখন বলা হয়, আল্লাহ যা কিছু নাযিল করেছেন তার উপর ঈমান আনো, তখন তারা বলে,
﴿نُؤْمِنُ بِمَا أُنزِلَ عَلَيْنَا وَيَكْفُرُونَ بِمَا وَرَاءَهُ وَهُوَ الْحَقُّ مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَهُمْ﴾
‘‘আমরা কেবল আমাদের উপর যা কিছু নাযিল হয়েছে তার উপর ঈমান আনি। এর বাইরে যা কিছু এসেছে তার প্রতি তারা কুফুরী করছে। অথচ তা সত্য এবং তাদের কাছে পূর্ব থেকে যে কিতাব রয়েছে তার সত্যায়নকারী’’। (সূরা বাকারা: ৯১)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَن يَفْعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰ أَشَدِّ الْعَذَابِ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ﴾
‘‘তোমরা কি কিতাবের এক অংশের উপর ঈমান আনছো এবং অন্য অংশের সাথে কুফুরী করছো? অতএব তোমাদের যারাই এমনটি করে তাদের প্রতিফল দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ভোগ ছাড়া আর কী হতে পারে? কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তিতে নিক্ষিপ্ত হবে। তোমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আল্লাহ বেখবর নন’’। (সূরা বাকারা: ৮৫)
কুরআনের এক অংশের প্রতি ঈমান আনয়ন করা অথবা আসমানী কিতাবসমূহের কোনোটির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং কুরআনের কোনো অংশ অথবা কোনো আসমানী কিতাবকে অস্বীকার করা সমস্ত আসমানী কিতাবকে অস্বীকার করার মতই কুফুরী। কেননা সমস্ত আসমানী কিতাব এবং সমস্ত নবী-রসূলের উপর ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। সেই সঙ্গে ঈমানের বিষয়গুলোর প্রতি একসাথে এমনভাবে অবস্থায় বিশ্বাস করা আবশ্যক, যাতে কোনো পার্থক্য ও বিভক্তি করণ এবং মতভেদ পরিলক্ষিত না হয়। যারা কিতাবের ব্যাপারে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে এবং মতভেদ করেছে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে দোষারোপ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ نَزَّلَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِي الْكِتَابِ لَفِي شِقَاقٍ بَعِيدٍ﴾
‘‘আল্লাহ তো যথার্থ সত্য অনুযায়ী কিতাব নাযিল করেছেন। কিন্তু যারা কিতাবের ব্যাপারে মতভেদ করেছে, তারা নিজেদের বিরোধের ক্ষেত্রে সত্য থেকে অনেক দূরে চলে গেছে’’। (সূরা বাকারা: ১৭৬)
প্রবৃত্তির অনুসরণ এবং বাতিল ধারণার বশবতী হয়ে বনী আদমের বিরাট অংশ আসমানী কিতাবগুলো কিংবা কতিপয় কিতাব অস্বীকার অথবা একই কিতাবের কিয়দাংশ অস্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে তাদের ধারণা, বিবেক-বুদ্ধি, রায় এবং মস্তিস্কপ্রসূত কিয়াসই সর্বোচ্চ দলীল। তারা নিজেদেরকে মহাজ্ঞানী এবং দার্শনিক হিসাবে নামকরণ করে থাকে। রসূল ও তাদের অনুসারীদেরকে নিয়ে তারা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে এবং তাদেরকে মূর্খ বলে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَلَمَّا جَاءَتْهُمْ رُسُلُهُم بِالْبَيِّنَاتِ فَرِحُوا بِمَا عِندَهُم مِّنَ الْعِلْمِ وَحَاقَ بِهِم مَّا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ﴾
‘‘তাদের নিকট যখন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলীসহ নিয়ে তাদের রসূলগণ এসেছিলেন তখন তারা নিজের কাছে বিদ্যমান জ্ঞানের দম্ভ করতো এবং তারা যা নিয়ে ঠাট্রা্-বিদ্রুপ করতো তাই তাদেরকে বেষ্টন করলো’’ (সূরা মু‘মিন:৮৩)।
আর রসূলদের অনুসারীদের ব্যাপারে কথা হলো, তারা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে অবতীর্ণ প্রত্যেক কিতাবের প্রতিই বিশ্বাস স্থাপন করে। তারা এগুলোর মাঝে কোনো পার্থক্য করে না। পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর প্রতি ঈমান আনয়ন করা হবে সংক্ষিপ্তভাবে। অন্তর ও জবানের মাধ্যমে এগুলোর স্বীকৃতি দেয়া আবশ্যক। আর কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়ন করতে হবে বিস্তারিতভাবে। কুরআনের প্রতি অন্তর ও জবান দিয়ে স্বীকৃতি প্রদান করা আবশ্যক, সেটাতে যা আছে তার অনুসরণ করা জরুরী এবং ছোট-বড় সব বিষয়েই কুরআনের অনুশাসন মেনে চলা ফরয। এই বিশ্বাস করাও কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের মধ্যে শামিল যে, সেটা কালাম, আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিল হয়েছে, সেটা সৃষ্টি নয়; বরং তার ছিফাত, আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সেটা এসেছে এবং আখেরী যামানায়[1] তার দিকেই ফিরে যাবে।
আল্লাহ তা‘আলার হিকমতের দাবি অনুযায়ী, পূর্বকালের কিতাবগুলো ছিল নির্দিষ্ট সময়-সীমার জন্য। সেগুলোর সংরক্ষণ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মানুষের মধ্য থেকে সেটার বাহকদেরকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّا أَنزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِن كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ﴾
‘‘আমি তাওরাত নাযিল করেছি। তাতে ছিল হিদায়াত ও আলো। আল্লাহর অনুগত নবীগণ সে অনুযায়ী ইয়াহূদীদের যাবতীয় বিষয়ের ফায়ছালা করতো। আর এভাবে রববানী ও আহবারগণও। কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাব সংরক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এবং তারা ছিল এর উপর সাক্ষী’’। (সূরা আল মায়িদা: ৪৪)
আর কুরআনুল কারীমের ব্যাপারে কথা হলো আল্লাহ তা‘আলা সেটাকে কিয়ামত পর্যন্ত সর্বযুগের সর্বস্থানের সমগ্র জাতির জন্য নাযিল করেছেন। তিনি নিজেই ইহাকে সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। কেননা পৃথিবীতে মানব জাতির অস্তিত্ব শেষ না হওয়া পর্যন্তকুরআনের দায়-দায়িত্ব শেষ হবেনা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾
‘‘নিশ্চয়ই আমি এ উপদেশ নাযিল করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক’’। (সূরা হিজর: ৯) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ﴾
‘‘সম্মুখ অথবা পশ্চাৎ হতে মিথ্যা এতে প্রবেশ করতে পারে না। এটি প্রজ্ঞাময় প্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ’’। (সূরা ফুচ্ছিলাত: ৪২)
মানব সমাজের সমস্ত বিবাদ-বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কুরআনকে ফায়ছালাকারী বানানো আবশ্যক এবং সমস্ত মতভেদের ক্ষেত্রে কুরআনের দিকে ফিরে আসা জরুরী। আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাব ব্যতীত অন্যের নিকট বিচার-ফায়ছালা নিয়ে যাওয়াকে তাগুতের নিকট বিচার-ফায়ছালা চাওয়া বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ﴾
‘‘তুমি কি তাদেরকে দেখো নি, যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তারা সে সমস্ত বিষয়ের উপর ঈমান এনেছে? তারা বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য তাগুতের কাছে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা যেন তাগুতের প্রতি কুফুরী করে’’। (সূরা নিসা: ৬০) الطاغوت শব্দটি الطغيان থেকে فعلون এর ওজনে আধিক্য বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। الطغيان অর্থ সীমালংঘন করা।
যারা সমস্ত আসমানী কিতাবের উপর ঈমান আনয়নের দাবি করে, অথচ কুরআন ও সুন্নাহর বিচার-ফায়ছালা বাদ দিয়ে কতিপয় তাগুতের বিচার-ফায়ছালা মেনে নেয়, আল্লাহ তা‘আলা তাদের নিন্দা করেছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে জাতি আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ কিতাব বাদ দিয়ে অন্য কিছু দিয়ে বিচার-ফায়ছালা করবে, তাদের পরস্পরের মধ্যেই যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে যাবে। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের অবস্থা পরিবর্তন হওয়া, তাদের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি হওয়া এবং তাদের মধ্যে মারামারি শুরু হওয়ার এটিই সবচেয়ে বড় কারণ। কেননা কিতাবের প্রতি ঈমানের দাবিতেই সেটার বিচার-ফায়ছালা মেনে নেয়া আবশ্যক। যে ব্যক্তি কিতাবের প্রতি ঈমান আনয়নের দাবি করে, অথচ সে কিতাব বাদ দিয়ে অন্য কিছুর নিকট বিচার-ফায়ছালা নিয়ে যায়, সে তার কথায় মিথ্যাবাদী। মূলতঃ আল্লাহর কিতাব অবিভাজ্য। জীবনে সকল ক্ষেত্রেই কিতাবের কুরআনের সব হুকুম বাস্তবায়ন করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা আবশ্যক। আকীদা, আমল ও জাগতিক লেন-দেন, ব্যক্তিগত কাজ-কর্ম, অপরাধ ও দ-বিধি, শিষ্টাচার এবং আচার-আচরণের ক্ষেত্রেও কিতাবের দাবি বাস্তবায়ন করা এবং সেটার হুকুম মেনে নেয়া আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الْكَافِرُونَ﴾
‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা কাফের’’। (সূরা মায়েদা: ৪৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الظَّالِمُونَ﴾
‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা যালেম’’। (সূরা আল মায়েদা: ৪৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الفَاسِقُوْنَ﴾
‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা ফাসেক’’। (সূরা আল মায়েদা: ৪৭) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا﴾
‘‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতোক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক মনে করবে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবুল করে নিবে’’। (সূরা আন নিসা: ৬০-৬৫)
এখানে কসমের মাধ্যমে জোর দিয়ে ঐসব লোক থেকে ঈমান নাকোচ করা হয়েছে, যারা ঝগড়া-বিবাদ নিষ্পত্তির ব্যাপারে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ফায়ছালাকারী হিসাবে মেনে নেয় না। সেই সঙ্গে বক্ষ প্রশস্ত করে এবং নত হয়ে আল্লাহর হুকুম কবুল করে নেয়া আবশ্যক। অনুরূপ যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার অবতীর্ণ কিতাব দ্বারা ফায়ছালা করে না, তিনি তাকে কাফের, যালেম ও ফাসেক বলেছেন। যদিও সে নিজেকে মুমিন ও ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী বলে দাবি করে।
ধ্বংস হোক ঐসব লোক, যারা তাগুতের তৈরী আইন-কানুন দ্বারা আল্লাহর কিতাব পরিবর্তন করেছে, অথচ তারা ঈমানের দাবি করে। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সৎকাজের তাওফীক পাওয়া যায় না এবং সুমহান আল্লাহর শক্তি ছাড়া অন্যায় কাজ থেকে বেঁচে থাকার কোনো শক্তি নেই।
[1]. আখেরী যামানায় এক রাতেই কুরআন উঠিয়ে নেয়া হবে। তখন মানুষের অন্তর এবং মুসহাফ থেকে কুরআন উঠে যাবে। তাদের অন্তরে ও মুসহাফে কুরআনের কোন অংশই অবশিষ্ট থাকবেনা। পৃথিবী তখন পাপাচারে ভরে যাবে। এমনকি আল্লাহ আল্লাহ বলার মত কোন লোক থাকবে না। তখন সেই নিকৃষ্ট লোকদের উপর কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।
নবী-রাসূলগণ সম্পর্কে সঠিক আক্বীদাহ
নবী-রাসূলগণ সম্পর্কে সঠিক আক্বীদাহ
রসূলগণের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ঈমানের অন্যতম রুকন। কেননা আসমানী বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে তারা আল্লাহ তা‘আলা ও মানুষের মাঝে মাধ্যম স্বরূপ এবং তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির উপর দলীল-প্রমাণ কায়েম করেছেন।
রসূলদের প্রতি ঈমান আনয়নের অর্থ হলো তাদের রিসালাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং তাদের নবুওয়াতের প্রতি স্বীকৃতি প্রদান করা। আরো বিশ্বাস করা যে, নবী-রসূলগণ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে যা কিছু বলেছেন, তাতে তারা সত্যবাদী। তারা তাদের রিসালাতের দায়-দায়িত্ব পৌঁছে দিয়েছেন এবং মানুষের জন্য যা অজ্ঞ থাকা মোটেই উচিত নয়, তা তারা বর্ণনা করেছেন।
নবী-রসূলদের প্রতি ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক হওয়ার অনেক দলীল-প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ﴾
‘‘তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল পূর্ব বা পশ্চিম দিকে প্রত্যাবর্তিত করার মধ্যে কোনো ছাওয়াব নেই; বরং পূণ্য তার, যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে’’। (সূরা বাকারা: ১৭৭)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ﴾
‘‘রসূল তার রবের পক্ষ থেকে তার উপর যে হিদায়াত নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে। আর যেসব লোক ঐ রসূলের প্রতি ঈমান এনেছে তারাও ঐ হিদায়াতকে মনে-প্রাণে স্বীকার করে নিয়েছে। তারা সবাই আল্লাহকে, তার ফেরেশতাদেরকে, তার কিতাবসমূহকে ও তার রসূলদেরকে বিশ্বাস করেছে এবং তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘‘আমরা আল্লাহর রসূলদের একজনকে অন্যজন থেকে আলাদা করিনা’’। (সূরা আল বাকারা: ২৮৫)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا أُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا﴾
‘‘যারা আল্লাহ ও তার রসূলদের সাথে কুফুরী করে, আল্লাহ ও তার রসূলদের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় এবং বলে আমরা কারো প্রতি ঈমান আনয়ন করবো ও কারো প্রতি ঈমান আনয়ন করবোনা। আর তারা কুফর ও ঈমানের মাঝখানে একটি পথ বের করতে চায়, তারা সবাই প্রকৃত কাফের’’। (সূরা আন নিসা: ১৫০)
উপরোক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা রসূলদের প্রতি ঈমান আনয়নকে তার প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি এবং কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনয়নের সাথে মিলিয়ে উল্লেখ করেছেন। সেই সঙ্গে যারা আল্লাহর প্রতি এবং রসূলদের প্রতি ঈমান আনয়নের মধ্যে পার্থক্য করবে এবং কারো প্রতি ঈমান আনবে ও কারো প্রতি কুফুরী করবে, তাদেরকে কাফের বলে উল্লেখ করেছেন।
মানব জাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে নবী-রসূল পাঠানো একটি বিরাট নিয়ামত। কেননা রসূলদের প্রতি মানুষের বিরাট প্রয়োজন রয়েছে। নবী-রসূলগণ ব্যতীত তাদের অবস্থা সুশৃঙ্খল ও সঠিক থাকা মোটেই সম্ভব নয়। রসূলদের প্রতি তাদের প্রয়োজন পানাহারের প্রয়োজনের চেয়েও অধিক। কেননা মানুষের সামনে আল্লাহ তা‘আলার পরিচয় তুলে ধরা, তাদের জন্য উপকারী বিষয়গুলো বর্ণনা করা এবং ক্ষতিকর বিষয়গুলো থেকে সাবধান করার ক্ষেত্রে তার মাঝে এবং তার সৃষ্টির মাঝে নবী-রসূলগণই একমাত্র মাধ্যম। সেই সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার শরী‘আত, হুকুম-আহকাম, আদেশ-নিষেধ ও বৈধ বিষয়াদি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা এবং তিনি যা ভালোবাসেন ও যা ঘৃণা করেন, তা বর্ণনা করার মাধ্যম একমাত্র তারাই। সুতরাং রসূলদের মাধ্যম ছাড়া এগুলো জানার কোনো উপায় নেই। কেননা মানুষের বিবেক-বুদ্ধি এগুলো বিস্তারিতভাবে জানতে ও সন্ধান পেতে সক্ষম নয়। যদিও তারা মোটামুটি সংক্ষিপ্তভাবে এগুলোর প্রয়োজন অনুভব করতে সক্ষম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ﴾
‘‘প্রথমে সব মানুষ একই পথের অনুসারী ছিল। তাদের মধ্যে যখন মতভেদ শুরু হলো তখন আল্লাহ নবীদেরকে পাঠালেন। তারা ছিলেন সত্য সঠিক পথের অনুসারীদের জন্য সুসংবাদদাতা এবং অসত্য পথ অবলম্বনের ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শনকারী। আর তাদের সাথে সত্য কিতাব পাঠান, যাতে সত্য সম্পর্কে তাদের মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছিল তার মীমাংসা করা যায়’’। (সূরা আল বাকারা: ২১৩)
রোগীর শরীর সুস্থ করার জন্য যেমন ডাক্তারের প্রয়োজন নবী-রসূলদের শিক্ষার প্রতি মানুষের প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি। কেননা ডাক্তার পাওয়া না গেলে রোগীর শরীর ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া ছাড়া আর কিছুই হয় না। কিন্তু নবী-রসূলদের শিক্ষার অভাবে মানুষের অন্তর ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অন্তরের ক্ষতি শরীরের ক্ষতির চেয়ে অধিক ভয়াবহ। ঐদিকে যমীনবাসীর মধ্যে যতদিন রিসালাতের প্রভাব বিদ্যমান থাকবে, পৃথিবী কেবল ততদিন বিদ্যমান থাকবে। যমীন থেকে নবী-রসূলদের রিসালাতের প্রভাব উঠে যাওয়ার সাথে সাথেই কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।
কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা যেসব রসূলের নাম উল্লেখ করেছেন, নির্দিষ্টভাবে তাদের প্রতি ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। তাদের সংখ্যা মোট ২৫জন। তাদের মধ্য থেকে ১৮ জনের নাম একসাথে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَتِلْكَ حُجَّتُنَا آتَيْنَاهَا إِبْرَاهِيمَ عَلَىٰ قَوْمِهِ نَرْفَعُ دَرَجَاتٍ مَّن نَّشَاءُ إِنَّ رَبَّكَ حَكِيمٌ عَلِيمٌ وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ كُلًّا هَدَيْنَا وَنُوحًا هَدَيْنَا مِن قَبْلُ وَمِن ذُرِّيَّتِهِ دَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ وَأَيُّوبَ وَيُوسُفَ وَمُوسَىٰ وَهَارُونَ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ وَزَكَرِيَّا وَيَحْيَىٰ وَعِيسَىٰ وَإِلْيَاسَ كُلٌّ مِّنَ الصَّالِحِينَ وَإِسْمَاعِيلَ وَالْيَسَعَ وَيُونُسَ وَلُوطًا وَكُلًّا فَضَّلْنَا عَلَى الْعَالَمِينَ﴾
‘‘ইবরাহীমকে তার জাতির মোকাবিলায় আমি এ যুক্তি-প্রমাণ প্রদান করেছিলাম। আমি যাকে চাই উন্নত মর্যাদা দান করি। তোমার রব প্রজ্ঞাময় ও মহাজ্ঞানী। তারপর আমি ইবরাহীমকে দান করেছি ইসহাক ও ইয়াকূবকে এবং সবাইকে সত্য পথ দেখিয়েছি, ইতিপূর্বে নূহকেও আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি। আর তারই বংশধরদের থেকে দাউদ, সুলাইমান, আইউব, ইউসুফ, মূসা ও হারুণকে। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে বদলা দিয়ে থাকি। তার সন্তানদের থেকে যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা ও ইলিয়াসকেও সঠিক পথ দেখিয়েছি। তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন সৎকর্মশীল। ইসমাঈল, আল ইয়াসা, ইউনুস ও লূতকে আমি সৎপথ প্রদর্শন করেছি। তাদের মধ্য থেকে প্রত্যেককে আমি সমস্ত দুনিয়াবাসীর উপর মর্যাদাসম্পন্ন করেছি’’। (সূরা আন-আম: ৮৩-৮৬) বাকী সাতজনের কথা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখ করেছেন।
আর যেসব নবীর নাম কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি, তাদের প্রতি সংক্ষিপ্তভাবে ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًا مِنْ قَبْلِكَ مِنْهُمْ مَنْ قَصَصْنَا عَلَيْكَ وَمِنْهُمْ مَنْ لَمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ﴾
‘‘তোমার আগে আমি বহু রসূল পাঠিয়েছি। আমি তাদের অনেকের কাহিনী তোমাকে বলেছি আবার অনেকের কাহিনী তোমাকে বলিনি’’। (সূরা মুমিন: ৭৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَرُسُلًا قَدْ قَصَصْنَاهُمْ عَلَيْكَ مِنْ قَبْلُ وَرُسُلًا لَمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَيْكَ وَكَلَّمَ اللَّهُ مُوسَى تَكْلِيمًا﴾
‘‘এর পূর্বে যেসব নবীর কথা তোমাকে বলেছি তাদের কাছেও আমি অহী পাঠিয়েছি এবং যেসব নবীর কথা তোমাকে বলিনি তাদের কাছেও। আমি মূসার সাথে কথা বলেছি ঠিক যেমনভাবে কথা বলা হয়’’। (সূরা আন নিসা: ১৬৪)
তাক্বদীর সম্পর্কে সহীহ আক্বীদাহ
তাক্বদীর সম্পর্কে সহীহ আক্বীদাহ
নিঃসন্দেহে ক্বদ্বা ও ক্বদর সাব্যস্ত করা এবং এতোদুভয়ের প্রতি বিশ্বাস করা ও তার অন্তর্ভুক্ত যাবতীয় বিষয়ের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ঈমানের বিরাট একটি রুকন। জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন, তখন তিনি জবাব দিয়েছেন যে,
(أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ)
‘‘তুমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে (১) আল্লাহ পাকের উপর (২) তার ফেরেস্তাদের উপর (৩) তার কিতাবসমূহের উপর (৪) তার রসূলদের উপর (৫) আখেরাত বা শেষ দিবসের উপর এবং (৬) তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপর’’।[2]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ﴾‘‘আমি প্রত্যেক জিনিসকে একটি পরিমাপ অনুযায়ী সৃষ্টি করেছি’’।[3] (সূরা কামার: ৪৯)
القدر শব্দটি قدرت الشيئ إذا أحطت بمقداره এর মাসদার। অর্থাৎ আমি জিনিসটির পরিমাণ-পরিমাপ নির্ধারণ করলাম। এ কথা আপনি তখনই বলে থাকেন, যখন উক্ত জিনিসের পরিমান-পরিমাপ সম্পর্কে আপনার পূর্ণ জ্ঞান থাকে।
এখানে القدر দ্বারা সৃষ্টিজগৎ অস্তিত্ব লাভ করার পূর্বেই সে সম্পর্কে আদিতে আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ ইলম থাকা উদ্দেশ্য। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা অবগতি, নির্ধারণ ও ইচ্ছা ব্যতীত কোনো কিছুই সৃষ্টি হয় না। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব হলো তাক্বদীরের ভালো-মন্দ ও মিষ্ট-তিক্ততার প্রতি ঈমান আনয়ন করাকে الإيمان بالقدر বলা হয়। তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়নের চারটি স্তর রয়েছে। যথা:
প্রথম স্তর: প্রত্যেক জিনিস অস্তিত্ব লাভ করার পূর্বেই আদিতে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার ইল্মের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। অর্থাৎ তিনি সকল বস্তুকে স্বীয় জ্ঞানের মাধ্যমে পরিবেষ্টন করে আছেন, -এ কথার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। আসমান ও যমীনে সরিষার দানা পরিমাণ বস্তুও তার জ্ঞানের বাইরে নয়। সৃষ্টি করার পূর্ব হতেই তিনি সকল বস্তু সম্পর্কে অবগত আছেন। তাদের রিযিক, বয়স, কথা, কাজ, চলাচল, অবস্থান, গোপন-প্রকাশ্য, তাদের মধ্যে কে জান্নাতী এবং কে জাহান্নামী তাও তিনি জানেন। বান্দাগণ আমল করার পূর্বেই তিনি তাদের আমলসমূহ সম্পর্কে অবগত থাকা এর অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয় স্তর: দ্বিতীয় স্তর হলো প্রথম স্তরে বর্ণিত সকল বিষয় আল্লাহ তা‘আলা লাওহে মাহফুযে লিখে দিয়েছেন। অর্থাৎ এ কথার উপর ঈমান আনয়ন করা এবং বিশ্বাস স্থাপন করা যে, আল্লাহ তা‘আলা ঐ সমুদয় বস্তুই লিখে রেখেছেন, যা হবে বলে তার জ্ঞানের আওতায় ছিল। লাওহে মাহ্ফুয ও কলমের প্রতি ঈমান আনয়নও উপরোক্ত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।
তৃতীয় স্তর: প্রত্যেক সৃষ্টির প্রতি আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা এবং তার উপর তার পরিপূর্ণ ক্ষমতার প্রতি ঈমান আনয়ন করা।[4]
চতুর্থ স্তর: এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক জিনিষের সৃষ্টিকর্তা। আরো বিশ্বাস করা যে, তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। তিনি ছাড়া বাকি সবকিছুই সৃষ্টি।[5]
[1]. আল্লামা শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আল-উছাইমীন রহিমাহুল্লাহ বলেন, القضاء ও القدر এর মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি না, এ ব্যাপারে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, أزل বা আদিতে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সবকিছু নির্ধারণ করে রাখাকে কদর বলা হয়। আর যথাসময়ে তা সৃষ্টির ফায়ছালাকে ক্বদ্বা বলা হয়। আল্লাহ যখন নির্দিষ্ট কোনো জিনিস অমুক সময় হবে বলে নির্ধারণ করেন, তখন তাকে কদর বলা হয়। আর যখন ঐ জিনিসটি সৃষ্টি করার নির্দিষ্ট সময় এসে উপস্থিত হয়, তখন তার ফায়ছালা করা এবং অস্তিত্বে নিয়ে আসাকে ক্বদ্বা বলা হয়। কুরআনুল কারীমে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَقُضِيَ الْأَمْرُ ‘‘তখন সবকিছুর ফায়ছালা হয়ে যাবে’’। (সূরা আল-বাকারা: ২১০) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,﴾ وَاللَّهُ يَقْضِي بِالْحَقِّ ﴿ ‘‘আল্লাহ সঠিকভাবে ফায়ছালা করেন’’। (সূরা গাফের: ২০) এ রকম আয়াত আরো রয়েছে। সুতরাং কদর হলো আদিতেই আল্লাহর নির্ধারণের নাম। আর ক্বদ্বা হলো সংঘটিত হওয়ার সময় সে সম্পর্কে ফায়ছালা করার নাম।
কেউ কেউ বলেছেন, ক্বদ্বা ও কদরের অর্থ একই। তবে প্রাধান্যপ্রাপ্ত কথা হলো, উভয় শব্দকে একসঙ্গে উল্লেখ করা হলে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হবে। আর যদি উভয়টিকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়, তাহলে উভয়টি দ্বারা একই অর্থ বুঝতে হবে। ঈষৎ পরিবর্তনসহ শাইখের কথা এখানেই শেষ।
কেউ কেউ বলেছেন, ভবিষ্যতে সৃষ্টিসমূহের যা কিছু হবে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার অবগতিকে কদর বলা হয়। আর আল্লাহ তা‘আলার ইলম ও ইচ্ছা অনুযায়ী সবকিছু সৃষ্টি করাকে ক্বদ্বা বলা হয়। (আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত)
[2]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল ঈমান।
[3]. অর্থাৎ দুনিয়ার প্রত্যেক বস্তুরই একটি পরিমাণ আছে। সে অনুসারে প্রত্যেক বস্তু একটি নির্দিষ্ট সময় অস্তিত্ব লাভ করে, একটি বিশেষ রূপ ও আকৃতি গ্রহণ করে। একটি বিশেষ সীমা পর্যন্ত ক্রমবিকাশ লাভ করে, একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত টিকে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। স্বভাবগত নিয়ম-নীতি অনুসারে এ দুনিয়ারও একটি 'তাকদীর' বা পরিমাণ আছে। সে অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তা চলছে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়েই তার চলার পরিসমাপ্তি ঘটবে। এর পরিসমাপ্তির জন্য যে সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে তার এক মুহূর্ত পূর্বে এর পরিসমাপ্তি ঘটবে না কিংবা এক মুহূর্ত পরে তা অবশিষ্টও থাকবে না। এ পৃথিবী অনাদি ও চিরস্থায়ী নয় যে, চিরদিনই তা আছে এবং চিরদিন থাকবে। কিংবা কোনো শিশুর খেলনাও নয় যে, যখনই তোমরা চাইবে তখনই তিনি এটিকে ধ্বংস করে দেখিয়ে দিবেন। (আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত)
[4]. তিনি যা করার ইচ্ছা করেন, তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হয়। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে এবং যা সৃষ্টি হবে, সে ক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতা এ দু’টির একটি অন্যটির জন্য আবশ্যক। আর যা সৃষ্টি হয়নি এবং যা সৃষ্টি হবেনা, সে ক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতা -এ দু’টির একটির জন্য অন্যটি জরুরী নয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যা করতে চেয়েছেন তাঁর কুদরতের মাধ্যমে তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। আর যা তিনি করতে ইচ্ছা করেননি, তা বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি ইচ্ছা করেননি, এ জন্যই বাস্তবায়িত হয় নি; এ জন্যে নয় যে, তিনি সেটি করতে সক্ষম নন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعْجِزَهُ مِنْ شَيْءٍ فِي السَّمَوَاتِ وَلاَ فِي الأَرْضِ إِنَّهُ كَانَ عَلِيمًا قَدِيرًا﴾
‘‘আল্লাহ এমন নন যে, আকাশমন্ডলী এবং পৃথিবীর কোনো কিছু তাকে অক্ষম করতে পারে। তিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান’’। (সূরা ফাতির: ৪৪)
[5]. আসমান-যমীন এবং এতোদুভয়ের মধ্যবর্তী স্থানের ছোট-বড় সকল বস্তুরই সৃষ্টিকর্তা তিনি। এ সমস্ত সৃষ্টির চলাচল এবং অবস্থানও তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি পবিত্র। তিনি ছাড়া কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। তিনিই একমাত্র প্রতিপালক।